আপনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনি দেশের রাজনীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রাজনৈতিকভাবে দেশ একটি ঘোরতর জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি দেশে থাকলেও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে, নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে অনেক সংকট তৈরি করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙন, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণ, খোলাখুলি ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়ন, সমান সুযোগের অভাবে নাগরিকদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ—এগুলোই হচ্ছে সংকটের রূপ। ছাত্র-তরুণেরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং গত বছর জুলাই-আগস্টে ত্বরিত ফুঁসে ওঠা রাজপথের রক্তাক্ত আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটে যায়। কিন্তু এর পরই জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিয়মশৃঙ্খলা এনে একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা সম্পর্কে শঙ্কা তৈরি হতে থাকে, কেননা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধের শক্তিগুলো, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্য প্রকাশ পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্মারক আক্রান্ত হতে থাকে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য, সাম্প্রতিক সময়ের মতো কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন যাতে আর না ফিরে আসে, সে জন্য অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোয় কিছু সংস্কার দরকার, তা সবাই মানে। কিন্তু সে অছিলায় সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলার একটি লক্ষণীয় চেষ্টা একধরনের নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। এটা জটিলতা। এই পটভূমিতে দেশে অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা যা দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগের কারণ। এসবের নিরসন ঘটিয়ে সমাজে শান্তি আনা, জাতীয় ঐক্য-সংহতি দৃঢ় করা বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগ তো এখন কার্যত দৃশ্যপট থেকে অপসারিত। বিএনপি কি শূন্যস্থান পূরণ করতে বা বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? জাতীয় পার্টি?
এই প্রশ্নে আমি কিছুটা কঠোর হব। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি জনগণের প্রয়োজনে জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দল নয়। সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দল, যা তাঁরা ক্ষমতায় বসে বানিয়েছেন এবং পরিকৌশলী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে রাজনীতি করে বিএনপি পোড় খেয়েছে, জনগণের কাতারে এসেছে। একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সাল থেকে ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলটি বড় আকারেই রয়েছে। কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কৌশল এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আশানুরূপ ফল পায়নি। ২০১৪ থেকে আমি একাধিকবার বলেছি, বিএনপির উচিত ছিল আওয়ামী লীগ সৃষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের পতন ঘটাতে না চেয়ে, বয়কট না করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট শুদ্ধ করার জন্য লড়াই করা। তাতে সার্বিকভাবেও দেশের রাজনীতির উপকার হতো। ছাত্রদের আন্দোলনসহ আরও নানা কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটায় এখন রাজনীতির মাঠ বিএনপির জন্যই অনুকূলে। তবে নিকট অতীতে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার বিএনপিও। এখনো চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রভৃতি পরিহারসহ দলের পরিশীলন ছাড়া বিএনপি জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারবে না। দলে তুলনামূলকভাবে চিন্তাশীল নেতৃত্বের দরকার ও তুলনামূলক বিশুদ্ধ রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে দলটিকে।
জাতীয় পার্টি, এর প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা এরশাদের সময়ই কেবল ক্ষমতায় ছিল। পরে মূলত একটি ‘প্রক্সি পার্টি’তে রূপান্তরিত হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে এরা কখনো সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় না। বরং একটি ‘বিকল্প নয়, বিকল্পের অংশীদার’ হিসেবেই তারা বেশি কাজ করে। বর্তমান রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সীমিতই থাকবে।