
রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অনুশোচনা নেই কেন
ফেসবুকে অনেক অপতথ্য দেখি। পোস্টদাতারা অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা ফেক আইডি থেকে গুজব ছড়ায়। তার ওপর আছে আশোভন মন্তব্য, খিস্তিখেউড়, ট্রল। যে যেমন পরিবেশে বড় হয়েছে, শৈশবে বাড়ির লোকেদের যে রকম আচরণ করতে দেখেছে, সেখান থেকেই তারা এসব শিখেছে। এ তো গেল ফেসবুক নিয়ে একটা গড়পড়তা সাধারণ ধারণা। আমি কারও কারও পোস্ট ফলো করি। আবার অনেকেরটা নাম দেখেই বুঝে যাই যে এগুলো আমার হজম হবে না। আমি সেসব উপেক্ষা করি। তার মধ্যেই কিছু কিছু ইতিবাচক ও মনকাড়া লেখা নজর কাড়ে।
সম্প্রতি এক ফেসবুক বন্ধুর একটা পোস্টে একটা তিতিরের সঙ্গে মাওলানা রুমির কথোপকথন পড়লাম। পাখিটি রুমিকে তিনটি পরামর্শ দিয়েছিল। শেষ পরামর্শটি ছিল: ‘সবাইকে উপদেশ দিতে যেয়ো না। শুধু তাদের উপদেশ দাও, যারা সেটা শুনবে, মনে রাখবে। মনে রেখো, কিছু কাপড় এত জীর্ণ হয়ে যায়, যা আর কখনো সেলাই করা যায় না।’ বাংলায় একটা প্রবচন আছে—কয়লার ময়লা যায় না ধুলে। স্কুলে আমাদের দিনিয়াত স্যার প্রায়ই এটা সুর করে বলতেন আর আমাদের ভালো হওয়ার উপদেশ দিতেন।
কেন জানি তিতিরের এই কথাগুলো পড়তে না পড়তেই চোখের সামনে আমাদের দেশের কিছু রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের চেহারা ভেসে উঠল। তাদের অনেককে দেখছি অনেক বছর ধরে। কাউকে কাউকে দেখছি তাদের রাজনৈতিক জীবনের জন্মক্ষণ থেকে। সারা দুনিয়ায় এত ওলট–পালট হলো, এত কিছু বদলে গেল, এমনকি আমাদের দেশের মানুষের মনও আর আগের মতো নেই, কিন্তু এসব রাজনীতিকের মধ্যে পরিবর্তনের কোনো ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে হয় না। সেই একই রকম চিন্তা, কথা, আস্ফালন।
মানুষ যে কত সহজেই নিজের কথা থেকে সরে আসে, তা আমাদের বড় বড় নেতাকে দেখলেই বোঝা যায়। এ জন্য গবেষণা করার দরকার নেই। আমি কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’ পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন। রাষ্ট্রপতি হলেন। সব দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামে একটিমাত্র দল বানালেন, যার সর্বময় ক্ষমতা রাখলেন নিজের হাতে। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ তিনি রাখলেন না। একটা সহিংস অভ্যুত্থানের শর্ত তিনি নিজেই তৈরি করে দিলেন।
মনে আছে, ১৯৭৬ সালের ১ মে জেনারেল জিয়াউর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মে দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে কমব্যাট পোশাক পরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। আমি ব্যারাকে ফিরে যাব।’ তিনি ব্যারাকে ফিরে যাননি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করা অবস্থায় তিনি একটা নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হলেন। বিএনপি নামে একটা দল বানালেন। তারপর নিজেই নিজেকে আহ্বায়ক করে ৭৬ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করলেন।
১৯৮৬ সালের কথা। স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন। খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পাঁচ দফা দাবির ভিত্তিতে এরশাদবিরোধী তুমুল আন্দোলন চলছে। উভয়েই ঘোষণা দিলেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হতে হবে। ১৯ মার্চ শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক সমাবেশে হুংকার দিলেন, পাঁচ দফা এড়িয়ে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে যারা অংশ নেবে, তাদের জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ২২ মার্চ তিনি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এরাশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা ও হাসিনা দুজনেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এরশাদের পতন হলে তাঁরা অনেকগুলো কাজ করবেন। তার মধ্যে কয়েকটি হলো: কালাকানুন বাতিল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করা। ১৯৯১ সাল থেকে তাঁরা পালা করে দেশ শাসন করেছেন। তাঁরা অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। অনেক রাস্তা, সেতু, ভবন তৈরি করেছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ কাজগুলো করার সময় পাননি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গুজব ছড়ানো
- জাতীয় সংসদ নির্বাচন