অর্থ সংস্কারে যুক্ত হোক ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আইন’
অন্তর্বর্তী সরকারের এক নম্বর সাফল্যের নাম ‘টিকে থাকা’, আর এক নম্বর ব্যর্থতার নাম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারা। শীতপ্রধান দেশে আবহাওয়া অফিস থেকে অনেক সময় দুটো তাপমাত্রা প্রকাশ করা হয়। একটি থার্মোমিটারে যা দেখায়, অন্যটি ‘অনুভূত মাত্রা’ বা ‘ফিলস লাইক’, যা থার্মোমিটারের পারদে দেখানো সংখ্যার চেয়েও প্রায়ই অনেক বেশি ঠাণ্ডার মাত্রা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত ডিসেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতির মাত্রা শতকরা ১০ দশমিক ৮৯ ভাগের কথা বললেও বাস্তবে সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে যে মূল্যস্ফীতি অনুভব করছে তা প্রায় ২০ শতাংশেরও বেশি। মন্ত্রীরা অনেক সময় দাম বৃদ্ধির সংখ্যা কমিয়ে বললেও বাজারে দাঁড়িয়ে জরিপ করলে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির সেই ‘অনুভূত মাত্রা’ হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।
বিবিএস বলছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির মাত্রা শতকরা ১২ দশমিক ৯২। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য এতটাই বাড়ছে যে সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর যথেষ্ট বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমন মনোভাব গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও লক্ষ করা যায়নি। গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) মতে, গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা ৭৮ লাখ মানুষকে নতুন করে দারিদ্র্যে ঠেলে দিয়েছে। আরো এক কোটি মানুষ গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি দমনে সরকারের পূর্ণাঙ্গ মনোযোগের অভাব রয়েছে। কারণ ‘ইতিহাস শুদ্ধি’ কিংবা নানামুখী ‘বিপ্লব-বাসনা’ ভেতর থেকেই সরকারকে বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল করে দিচ্ছে, যার জন্য অর্থনীতির অগ্রাধিকারমূলক কাজগুলো পেছনের বেঞ্চে আসন পেয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ৫ দশমিক ৪ ভাগ, যা বেড়ে ২০১১ সালে ১১ দশমিক ৪ ভাগে উন্নীত হয়। এর পেছনের মূল কারণ ছিল বিশ্বব্যাপী তেলের দামের উল্লম্ফন। ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ২০০৯ সালে ৬২ ডলার থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ১৬০ ডলারে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১২ সালেই বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসে। এরপর তিন বছর মূল্যস্ফীতি সামান্য বাড়লেও ২০১৬ সালে তা শতকরা সাড়ে ৫ ভাগে নেমে আসে, যা বাংলাদেশের মতো এক উন্নয়নশীল ও খানিকটা উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতির জন্য এক সহনীয় মাত্রা। এ প্রবণতা ২০২১ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল। ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি শতকরা ৮ ভাগে এবং ২০২৩ সালে ১০ ভাগে পৌঁছে যায়। সেই থেকে এটি আর কমেনি, যার পেছনে অভ্যন্তরীণ ভুল নীতিই মূলত দায়ী।
এ ভুল নীতিগুলো যেন সরকার বারবার না নিতে পারে তার জন্য মূল্যস্ফীতি দমনে অনেক উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণীত হওয়া উচিত। অর্থবিষয়ক সংস্কার কর্মসূচিতে মূল্যস্ফীতি দমনে মুদ্রানীতি ও প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি হাতিয়ারগুলোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের লক্ষ্যে একটি আধুনিক ‘মূল্যস্ফীতি দমন আইন’ থাকা আবশ্যক। আইন করে কি মূল্যস্ফীতি দমন করা যায়? কেউ বলবেন, আইন করে মূল্যস্ফীতি কমানো গেলে পৃথিবীতে সব দেশই তা করত। তবে আইন এক ধরনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে, যা শাসকদের রাজনৈতিক পছন্দগুলোকে পেছনে ফেলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে আদিষ্ট করে। এটিই আইন থাকার যুক্তি।
প্রকল্পের স্বার্থে ঘাটতি বাজেটে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি দমনে পূর্ণ সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করেন না। তাই আইন থাকাই ভালো। বিষয়টি অনুধাবন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২২ সালের আগস্টে ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ চালু করেন, যা আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির জ্বালা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ২০২২ সালের আগস্টে মার্কিন মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ৮ দশমিক ৩ ভাগ, যা ঠিক এক বছর পর ৩ দশমিক ৭ ভাগে এবং দুই বছর পর ২ দশমিক ৫ ভাগে নামে। অবশ্য এর পেছনে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রাগত কষায়ণ বা সুদবৃদ্ধির ভূমিকাই বেশি। তবে সরকারও নিজেকে কষনি দিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন ইচ্ছেমতো সরকারি ব্যয় বাড়ানোর যে স্টাইল আগে অনুসরণ করত এখন তাতে টান পড়েছে। মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্বনীতিও মূল্যবৃদ্ধি দমনে সচেষ্ট হয়েছে এবং মার্কিন মূল্যস্ফীতি এক নিরাপদ অংকে নেমে এসেছে।
এ আইনের তিনটি পদক্ষেপ রয়েছে, যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো যায় বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে এক. রাজস্ব ঘাটতি কমানো। দুই. দেশের ভেতরে জ্বালানির বিকল্প তৈরি করা ও তিন. সকল প্রকার সবুজায়ন প্রকল্পকে উৎসাহিত করা এবং দক্ষতাবর্ধক কাজের কর সুবিধা প্রদান। প্রথাগত নিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার জানে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদার ধাক্কায় যে মূল্যস্ফীতির উদ্ভব ঘটে তার নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধহস্ত। যেমন হঠাৎ বিনিয়োগ চাহিদা বেড়ে গেলে গভর্নর সুদহার বাড়িয়ে দিয়ে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমিয়ে এনে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পারেন। কিন্তু বাজেটের ঘাটতি বেড়ে গেলে সরকার যত উচ্চ সুদেই হোক ঋণ করবেই। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এ জায়গায় আইন থাকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকার তা মানতে বাধ্য হবে।