সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে কেন এত প্রশ্ন
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসনের পতন হয় এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বহুল আলোচিত–সমালোচিত, দমন-পীড়নমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সরকার আগের আইনটি বাতিল করে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ পাস করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।
এ অধ্যাদেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এমন কিছু বিষয় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে এবং নতুন যুক্ত করা হয়েছে, যা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষকে আশঙ্কামুক্ত করতে পারেনি।
ইতিবাচক পরিবর্তন
প্রথম উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত অধ্যাদেশে ‘সাইবার সুরক্ষা’ হিসেবে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে [ধারা ২(ভ)]। তবে এ অধিকার ক্ষুণ্ন হলে কোথায়, কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কেউ যদি কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তাহলে কী শাস্তি হবে, সেটাও এখানে উল্লেখ নেই। এ ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া এবং কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তির বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা জরুরি ছিল।
নতুন অধ্যাদেশের (ধারা ২০) সাইবার স্পেসে জুয়াখেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুয়াখেলার জন্য কোনো অ্যাপ, ডিভাইস তৈরি বা খেলায় অংশগ্রহণ বা সহায়তা করলে এবং উৎসাহ দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
আরেকটি ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু বিতর্কিত ধারা এ অধ্যাদেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড (ধারা ২১); পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ (ধারা ২৪); আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি (ধারা ২৫); অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ইত্যাদির দণ্ড (ধারা ২৬); মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদি (ধারা ২৯) এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড (ধারা ৩১)।
এই ধারাগুলো ছিল অস্পষ্ট ও বিস্তৃত। এসব ধারায় বৈধ মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিগত সরকারের আমলে এসব ধারায় মামলা করে বিরোধী মত দমন করার বহু উদাহরণ রয়েছে। রাজনীতিক, অ্যাকটিভিস্ট, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকেই এসব মামলায় ভুক্তভোগী ছিলেন।
বিতর্কিক যে ধারাগুলো বহাল রইল
বিতর্কিত বেশ কিছু ধারা বাতিলের পাশাপাশি পুরোনো কিছু ধারা সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে বহাল রাখা হয়েছে, যেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনেও ছিল। এই ধারাগুলো বহাল থাকায় তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ রকম কয়েকটি ধারা হলো—
‘কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ ও ব্লক করার ক্ষমতা’
বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৮(১) ধারার মতো সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৮(১) ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) যেকোনো কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৮(২) ধারা অনুসারে, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা এর কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে এমন কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করা যাবে।
কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার যে কারণগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অস্পষ্ট ও বিস্তৃত। ফলে এগুলোর অতিরিক্ত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা দেশের সংহতির মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করায় তা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অনুমোদিত সীমার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি। এ ধারার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে একতরফা কনটেন্ট ব্লক করা এবং অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কী কারণে কোন কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে বিচারিক পর্যালোচনা, জবাবদিহি ও পরিসংখ্যান প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার বিষয়টি শুধু একটি স্বাধীন সংস্থার (আদালত বা বিচারিক সংস্থা) সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এবং সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত। শুধু গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এটি সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
এ ধারা সাংবাদিকতা, অনলাইন অ্যাকটিভিজম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ ধারা বহাল থাকলে ব্লকিং, ফিল্টারিং ও সেন্সরশিপকে উৎসাহিত করবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাইবার আইন