বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘সমতা’ ফেরাতে এখন যা করতে হবে
২০১১ সালের কথা। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহন করা হলো। এ জন্য বাংলাদেশ কোনো ধরনের মাশুল গ্রহণ করেনি। শুধু তা-ই নয়, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়ার বিদ্যমান সড়কপথের ব্রিজ ও কালভার্টগুলো এই ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের উপযুক্ত নয় বলে তিতাস নদ ও তার খালগুলো রীতিমতো ভরাট করে বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হয়।
এ কারণে বর্ষাকালে বাড়তি পানিপ্রবাহ এক পাশে আটকে থাকায় আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন স্থানের কৃষিজমিতে দীর্ঘ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, চাষাবাদেও ব্যাঘাত ঘটে। সে বছরের আগস্টে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বাড়তি বৃষ্টির পানি আখাউড়া স্থলবন্দর সড়কের আবদুল্লাহপুর ও নূরপুর জাজি সেতুর নিচের বিকল্প পথে আটকে যায়। এ কারণে আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর, কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর ও বঙ্গেরচর গ্রামের বাসিন্দারা কী পরিমাণ ভোগান্তিতে পড়েছিলেন, তা উঠে এসেছিল প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে। (বিকল্প পথের কারণে ভোগান্তি, প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১১)
ভারতকে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট দেওয়ার জন্য তিতাস নদ ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের অবিশ্বাস্য ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে আমি ২০১১ সালের ডিসেম্বরে একটি লেখা লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল, ‘ট্রানজিটের পয়লা মাশুল: তিতাস একটি খুন হয়ে যাওয়া নদীর নাম!’ এরপর ২০১৪ সালে আবারও এই পথে বিনা শুল্কে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য ট্রানজিটের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ। এ জন্য ৫৮ কিলোমিটার সড়কপথের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বাংলাদেশ বহন করে। ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল সম্প্রতি সেই ত্রিপুরারই আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের হামলার ঘটনাকে উপলক্ষ করে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বাংলাদেশ তার নদী, কৃষিজমি, পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষতি করে এই যে ভারতকে ট্রানজিট দিল, বিনিময়ে কী পেল?
ট্রানজিট দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, এর ফলে বাংলাদেশ হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করবে। যেমন এডিবির এক সমীক্ষার সূত্র ধরে বলা হয়েছিল, ট্রানজিট দেওয়ার প্রথম পাঁচ বছরে বাংলাদেশ বার্ষিক ৫ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা (১ ডলার সমান ৭০ টাকা ধরে) এবং এর পরের বছরগুলোয় বার্ষিক ৫০ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করে আয় করতে পারবে। (ট্রানজিটের লাভক্ষতি: সমীক্ষা কী বলে?, প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১১)
বাস্তবে কী ঘটল? বাংলাদেশ ট্রানজিটকে অগ্রাধিকার দিয়ে সড়ক ও রেলপথে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প করল ঠিকই, কিন্তু আয় হলো সামান্য। যেমন ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল—এই তিন বছরে ভারতের কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ মাশুল পেয়েছে মাত্র ২৮ লাখ টাকা!
কাজেই ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে বাংলাদেশের বন্দর, নদী ও সড়ক ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশের লাভ–লোকসান পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করতে হবে। শুধু ট্রানজিট চুক্তিই নয়, গত দেড় দশকে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সমুদ্র, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষাসহ সামরিক–বেসামরিক বহু ধরনের চুক্তি হয়েছে। এসব চুক্তি সম্পর্কে বাংলাদেশে তেমন কোনো আলোচনা বা তর্কবিতর্ক হয়নি, দেশের মানুষকে চুক্তিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানতেও দেওয়া হয়নি।
এর মধ্যেই যে কয়েকটি চুক্তি সম্পর্কে নানাভাবে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয় বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। যেমন রামপাল প্রকল্প ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প হলেও এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ অর্থ এসেছে ভারতীয় ঋণ থেকে, যা সুদসহ পরিশোধ করার দায় বাংলাদেশের। সেই সঙ্গে রয়েছে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার বিপদ।
আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিটিও জাতীয় স্বার্থবিরোধী। কারণ, কয়লার দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ তুলনামূলক বেশি, বাংলাদেশের জন্য জরিমানার বিধান থাকলেও আদানির জন্য জরিমানার কোনো বিধান না থাকা, ভারত সরকার থেকে আদানি করছাড় পেলেও বিদ্যুতের দামের সঙ্গে সমন্বয় না করা ইত্যাদি। এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিগত সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি প্রকাশ এবং চুক্তিগুলোকে খতিয়ে দেখে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো বাতিলের উদ্যোগ নিতে হবে।