অনুভূতির থাকা না থাকা
বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলো দেখা বা ছোঁয়া যায় না। এগুলো অবশ্যই হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিতে হয়। এর নাম অনুভূতি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির একটি হচ্ছে অনুভূতি। এটি না থাকলে আপনি যে বেঁচে আছেন তার প্রমাণ থাকে না। অনুভূতি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের জাগরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অনুভূতিপ্রবণ বাঙালির একসময় অনুভূতি ছিল সর্বজনীন। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমরা যে অনুভূতি দেখেছি তার নাম দেশপ্রেম। সে অনুভূতি না থাকলে দেশ স্বাধীন হতো না। পরে অনুভূতি আরেক ধরণের হয়ে গেল। পঁচাত্তরের পর আমরা অনুভুতি প্রকাশে সাবধান হয়ে গেলাম। কারণ সব অনুভূতি যে সমান না সেটা শেখানো হলো আমাদের।
আবেগ হলো মনের একটি বিশেষ অবস্থা যার দ্বারা আমরা আমাদের কান্না, হাসি, রাগ ও দুঃখ অনুভব করি, প্রকাশ করি। অধিকাংশ মানুষের আচরণ তাদের আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে আবেগ হলো মনের সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশমান অবস্থা যা একজন ব্যক্তিকে দৈহিক এবং মানসিক দিক থেকে বিচলিত করে। কোন মানুষের খুশিতে উচ্ছল হওয়া, ভয় পাওয়া, বিস্ময়ে অবাক হওয়া, রাগে উত্তেজিত হওয়া সবই আবেগের অনুভূতি আর তার দৈহিক প্রকাশ নিবিড়ভাবে জড়িত।
তার মানে অনুভূতি সবার। আচ্ছা এখন কি আসলেই সবাই পারে অনুভূতি প্রকাশ করতে? যেমন ধরুন এক সময়ের রাজনীতি ও তার শাসকের জন্য আপনার কোন ভালো অনুভূতি থেকে থাকলে তা কি এখন বলা সম্ভব? আবার যারা দলকানা বা অন্ধ তার জুলাই মাসে নিহত-আহতদের বেলায় কী শোক ও বেদনার অনুভূতি প্রকাশ করবেন? দুটোর উত্তরই হবে না। তাহলে সর্বজনীন হলো কিভাবে?
আজকাল আমরা মাঝে মাঝে অনুভূতিকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ছবিতে মিডিয়ায় এমন অনুভূতি কি প্রমাণ করে? বলে দেয়, আর যাই করো হে বাপু সব অনুভূতি প্রকাশ করো না, সব অনুভূতি প্রকাশ করতে নেই।
সৌভাগ্য হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ফাহমিদা খাতুনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার। তার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার। সিডনিভিত্তিক বাংলা টিভি বাংলার মুখ তখন বেশ জনপ্রিয়। তাদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে জেনেছিলাম ফাহমিদা খাতুনের অনুভূতি। আপনি আমি হয়তো ভাবছি কপালে টিপ পরা নারীদের দেখলে এখন যে বিরূপ অনুভূতি প্রকাশ করা হচ্ছে তা সাম্প্রতিক সময়ের কিছু। প্রকৃতপক্ষে তা না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন ফাহমিদা খাতুনকে পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা খুঁজে ফিরেছিল। তাদের ভাষায় টিপ পরা হিন্দু মহিলাটি কোথায়? যে কালীর গান গায়? মা কালীর গান বলতে তারা কোনটা মনে করতো জানেন? রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’ এটা নাকি কালীর গান। এই যে ভিন্ন অনুভূতি তার বেলায় আমরা কি বলব? টিপ পরায় পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেকের হেনস্তার শিকার হওয়া ঢাকার তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দারের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি আমরা। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়।
অনুভূতি মানুষ জাতি ও রুচিভেদে ভিন্ন। আজকাল সংবেদনশীল মানুষ যে কোনো কিছুতেই তেতে ওঠে। আমাদের দেশে আমাদের সমাজে এখন যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনুভূতি হয়ে গেছে একতরফা। আপনি বা আপনারা যা খুশি বলতে পারবেন, করতে পারবেন আর এক দলকে অপমান করতে পারবেন এমন কি পিটাতেও পারবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বললেও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। কিছু বলা যাবে না। তার মানে একদল বলবে করবে আর একদল মুখ বুঁজে সহ্য করবে। এই অপমান বা অনাচারের মূল জায়গা করে দিচ্ছে বিশ্বাস। আচার-আচরণ বা সংস্কৃতি অনুভূতির বড় শিকার। কারো অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের গায়ে লাগে এমন গান গাওয়া বা আচরণ করা যাদের সঠিক অনুভূতি তারা নিজেদের বেলায় কি তা মানতে পারবেন? আপনার অনুষ্ঠানে আরো কাউকে কি বলতে দেবেন, গাইতে দেবেন?
অনুভূতির বেলায় বাঙালি এমন একমুখি। যে যখন ক্ষমতা পায়, অনুভূতি তখন তার বা তাদের দাস। তারা যে ভাবে যা প্রকাশ করেন তাই হচ্ছে সফল ও সঠিক। বাকিরা আধো ভয়ে, আধো লাজে আর আধো সংকোচে বলতে গিয়ে বলেন না। করতে গিয়ে করতে পারেন না। আর হ্যাঁ, ক্ষমতাসীনের সঙ্গে সহমত হতে না পারলে নিগৃহীত হওয়াটাও কিন্তু অনুভূতি। এর ভেতর কারো ব্যথা বা আঘাত লাগলে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু সংখ্যায় যারা বেশি, যাদের পেশির জোর আছে, তারা মারতে পারার অনুভূতির লাইসেন্স পেয়ে গেছে।