আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের বাধা কোথায়
দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আন্তসীমান্ত নদীতে বাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারত পানি-বণ্টন নিয়ে আলোচনাটি আবারও সামনে এসেছে। দাবি উঠেছে, দুই দেশের মধ্যে পানিবণ্টনের বিষয়টি অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হতে হবে এবং পানির ওপর ভাটির দেশের অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। অথচ বাংলাদেশ এমন কোনো আন্তর্জাতিক আইনে স্বাক্ষরই করেনি।
বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টন সমস্যার প্রেক্ষাপট
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন বড় নদী আছে প্রায় ৫৪টি। এই অভিন্ন নদীগুলোর প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে উজানে বাঁধ দিয়ে রেখেছে ভারত। শুধু গঙ্গা নদীর উজানেই এ পর্যন্ত প্রায় ৩৬টি ব্যারাজ ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টনসংক্রান্ত মতবিরোধ তুঙ্গে উঠে যখন ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু হয়।
১৯৬১ সালে শুরু হয়ে এই ব্যারাজ নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৯৭৪ সালে। মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গা নদী থেকে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে হুগলি-ভাগীরথী নদী ব্যবস্থায় প্রবাহিত করে শুষ্ক মৌসুমে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা করা। গঙ্গা নদীতে এই ব্যারাজ এবং একে ঘিরে পানি কূটনীতির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনেকটা এ রকম:
(১৯৫১-১৯৭০): ফারাক্কা বাঁধটি ঘিরে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পদ্মায় একটি বিপরীত ব্যারাজ নির্মাণের ঘোষণা।
(১৯৭২-১৯৭৬): ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল একটি অস্থায়ী ৪১ দিনের চুক্তির অধীনে ব্যারাজটি চালু করা হয়। তবে এরপর আর কখনো এটি বন্ধ হয়নি। ভারত কর্তৃক ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে একতরফা পানির প্রত্যাহার শুরু হলে সম্ভাব্য পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘে আপত্তি উত্থাপন করে।
(১৯৭৭-১৯৮২): বাংলাদেশ ও ভারত প্রথম পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর, যার মেয়াদ ছিল ১৯৭৭-৮২। চুক্তিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’। চুক্তিটি পুনর্নবায়নের অঙ্গীকার থাকলেও তা করা হয়নি। চুক্তিটিতে ফারাক্কার উজানে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করার কথাও বলা ছিল।
তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল, যাতে সেখানকার পাহাড়ি অঞ্চলে জলাধার নির্মাণ করে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। তবে ফারাক্কার উজানে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু বিকল্প প্রস্তাবও ভারত দিয়েছিল। যার একটি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটি খাল খনন করে পানি ফারাক্কার উজানে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া।
■ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন লবণাক্ততার সমস্যায় আক্রান্ত।
■ সমতার ভিত্তিতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তির উদাহরণ এই উপমহাদেশেই আছে।
■ এখানে দুই পক্ষের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ এসে মধ্যস্থতাও করতে পারে, যেমনটি বিশ্বব্যাংক করেছিল সিন্ধু নদীর চুক্তির ক্ষেত্রে।
(১৯৮২-১৯৮৮): ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে ১৯৭৭ সালের চুক্তিটির সামান্য পরিবর্তন করে দুটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। একটি প্যাকেজ চুক্তির আওতায় এ অঞ্চলের সব নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে অববাহিকাভিত্তিক উন্নয়ন তথা চুক্তির ধারণা এ সময় আলোচনায় এলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
(১৯৮৮-১৯৯২): একতরফা পানি প্রত্যাহার আবার শুরু হয়। কিন্তু কোনো ফলাফল ছাড়াই আলোচনা চলতে থাকে।
(১৯৯৩-১৯৯৫): এ সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো সংলাপ হয়নি। তৎকালীন সরকার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়টি অন্যায্য উল্লেখ করে আপত্তি উত্থাপন করে।
(১৯৯৬-২০০১): ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে একটি ৩০ বছর (১৯৯৬-২০২৬) মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো এটিতে কোনো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল না।
(২০০২-২০০৮): ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ চুক্তিটি সংশোধন এবং সালিসির জন্য একটি বিধান প্রস্তাব করে, যার কোনোটাই সম্ভব হয়নি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- তিস্তার পানি বন্টন
- পানি চুক্তি