সাম্প্রতিক বন্যা ও কিছু অতিরিক্ত ভাবনা
সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বড় বন্যা হয়ে গেল, যার ধকল এখনো পোহাতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। গোমতী, মুহুরী ও ফেনী নদীর উজানে তাদের ক্যাচমেন্টে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ছিল সাম্প্রতিক এ বন্যার জন্য দায়ী। ক্যাচমেন্টগুলোর আকার ছোট এবং ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় বৃষ্টির পর কিছু সময়ের মধ্যেই নদীর পানির লেভেল দ্রুত বেড়ে যায়, আবার বৃষ্টির পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানি দ্রুত নেমেও যাওয়ার কথা। এজন্যই এ নদীগুলোকে আমরা বলি ফ্ল্যাশি নদী। নদীর পানি কমে গেলেও প্লাবনভূমির পানি কিন্তু এখনো কমেনি।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক এ বন্যাকে কোনোভাবেই ঠেকানো যেত না। তাহলে আমরা কীভাবে এ বন্যার ইমপ্যাক্ট বা ক্ষতি কমাতে পারতাম? মানুষের পূর্ব প্রস্তুতির জন্য দরকার বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ, যা এ রকম ফ্ল্যাশি নদীর জন্য সহজ নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফ্লাড ফোরকাস্টিং ও ওয়ার্নিং সেন্টারের (এফএফডব্লিউসি) পুরো বাংলাদেশের জন্য ফোরকাস্টিং বা পূর্বাভাস মডেল আছে, গোমতী, মুহুরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী, সাংগু এসব পাহাড়ি, ছোট ও ফ্ল্যাশি ক্যাচমেন্ট ছাড়া। বড় ক্যাচমেন্ট বা বেসিনের (যেমন—ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা) জন্য এ কাজটি সহজতর কারণ এসব নদীর পানির লেভেল তুলনামূলক ধীরে বাড়ে (একদিনে হয়তো সর্বোচ্চ ৪০-৫০ সেমি)। বেসিনের আকার বড় হওয়ার কারণে বেসিনের বৃষ্টি ও নদীর উজানে পানির লেভেলের ডাটা দিয়ে এক-পাঁচদিন আগে ফোরকাস্ট দেয়া সম্ভব হয়। অন্যদিকে ফ্লাশি ক্যাচমেন্টগুলোয় ২৪ ঘণ্টারও অনেক কম সময়ে পানির লেভেল বাড়তে পারে (বৃষ্টির পরিমাণ ও ক্যাচমেন্ট বিশেষে) ৩-৫ মিটার। এসব ক্যাচমেন্টে বন্যার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় আগে বৃষ্টি কত হতে পারে তার পূর্বাভাস জানতে পারা। তবে বৃষ্টি নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা দুরূহ।
ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যার জন্য নদীতে পানির লেভেল কত হবে তার এত অ্যাকুরেসি বা নির্ভুলতার প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন হচ্ছে বলতে পারা কোথায় কোথায় আকস্মিক বন্যা হতে পারে, আর তা কী মাত্রার হতে পারে। বিভিন্ন অবস্থানে ঘটে যাওয়া বৃষ্টি ও সম্ভাব্য বৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে একটা ক্যাচমেন্টভিত্তিক অপারেশনাল ফ্লাড অ্যালার্ট সিস্টেম করা সম্ভব, যাতে কোন এলাকাগুলো সময়ের সঙ্গে কী রকম ঝুঁকির মধ্যে আছে তা সবাই জানতে পারে। এতে অন্তত কয়েক ঘণ্টা লিড টাইম বা আগাম সময় পাওয়া যেতে পারে যা মানুষকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর এবং অন্যান্য প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে। ভারতের ফোরকাস্টিং ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে এ রকম একটা সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাটা আপডেট করে।
পুরো বাংলাদেশের জন্য তৈরি করা আধুনিক বন্যা পূর্বাভাস মডেলের মতো কিছু এখানে সম্ভব না, এবং প্রয়োজনও নেই। প্রয়োজন হচ্ছে প্রথমত, বৃষ্টির আগাম বার্তা পরিমাণগতভাবে এবং স্থানভিত্তিক আরো সুনির্দিষ্ট করা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৮৯ মিমি-এর চেয়ে বৃষ্টিকে প্রবল বৃষ্টি হিসেবে বিভাগভিত্তিক পূর্বাভাস দেয়া ছোট পাহাড়ি ক্যাচমেন্টগুলোর জন্য খুব উপকারী না; ৯০ মিমি বৃষ্টি আর ২০০ বা ৩০০ মি মিঃ বৃষ্টির মধ্যে অনেক তফাত। প্রয়োজন হচ্ছে এই রেঞ্জের উঁচু মাত্রার বৃষ্টিকে আরো সুনির্দিষ্ট করা, যেমন ১০০-১৫০, ১৫০-২০০, ২০০-২৫০ মিঃ মিঃ, ইত্যাদি এবং ক্যাচমেন্ট হিসাবে বলতে পারা। ইন্ডিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) এ রকম ক্ল্যাসিফিকেশন আছে। বিএমডি ও আইএমডির ডাটা সমন্বয় করে এর ওপর ভিত্তি করে ক্যাচমেন্টভিত্তিক ফ্লাড অ্যালার্ট সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এর মাধ্যমে এ মুহূর্তে বন্যার পরিস্থিতি কী (নাউকাস্টিং) এবং আগামী ১২ ঘণ্টা বা ২৪ ঘণ্টা পরে কী পরিস্থিতি হতে পারে (ফোরকাস্টিং) তার একটা অনুমান পাওয়া সম্ভব হবে। আমি আরো মনে করি, খুব সহজ হাইড্রোলজিক্যাল মডেল দিয়ে পানির সম্ভাব্য প্রবাহ ও লেভেল কতটুকু এবং কত দ্রুত বাড়তে পারে, কিছু অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও একটা পর্যায়ে বলা সম্ভব।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আকস্মিক বন্যা