সরকারের কাজের পরিধির ওপর নির্ভর করবে এর মেয়াদ
সলিমুল্লাহ খান ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক। বাংলাদেশে একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হিসাবে তার খ্যাতি রয়েছে। বেশকিছু চিন্তা উদ্রেককারী গ্রন্থ রয়েছে তার। তিনি সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের পট পরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সলিমুল্লাহ খান : বহু আগেই এ পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল। আমি এটিকে বিলম্বিত চিকিৎসা হিসাবে দেখি। এ চিকিৎসাটা হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, এ কথা সত্য। তবে সেটা নিয়েও বহু প্রশ্ন ছিল। ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচনে তিনি যে আসলে পরাজিত হয়েছিলেন, তা সবাই জানেন। তিনি জানতেন পরাজিত হবেন। এ পরাজয় ঢাকার জন্যই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিল করেন, নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। একপর্যায়ে একজন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবকে (সুজাতা সিং) ডেকে এনে কোনো এক পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেন। এভাবে জয়ী হওয়ার চেয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পরাজিত হওয়া ভালো ছিল। অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পরাজিত হলেও আওয়ামী লীগ হয়তো আরেকবার ফিরে আসতে পারত। প্রশ্ন হলো, অনির্বাচিত একটি সরকার কীভাবে এতদিন ইচ্ছামতো দেশ ধ্বংস করল আর দেশের মানুষও এই অন্যায় ১৫ বছর ধরে মেনে নিল? আমি তাই এ পরিবর্তন খুবই অপরিহার্য ছিল মনে করি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য?
সলিমুল্লাহ খান : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুই সরকারের মাঝখানের সরকার। আগের সরকারের অবস্থা আমরা দেখেছি। তারা ২০০৯ সালে নির্বাচিত হওয়ার আগে জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটার বাস্তবায়ন করেনি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারা জনগণকে কি তখন বলেছিলেন, আমরা নির্বাচিত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করব? না, বলেননি। আমাদের মতো প্রজাতন্ত্রে সরকার জনগণের অনুমতিপ্রাপ্ত কি না, এর একমাত্র প্রমাণ অবাধ নির্বাচন। কিন্তু কোনো সরকার যদি নির্বাচনে কারচুপি করে, তাহলে মানুষ মানবে না। আগের সরকার যা করেছিল, তা রীতিমতো একটা চৌর্যবৃত্তি, একটা সংবিধানবিরোধী অভ্যুত্থান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বসেছে ওই সমস্যার সমাধান হিসাবে। আর একটি অভ্যুত্থানের দৌলতে গঠিত হয়েছে এ সরকার। এতেই বোঝা যায়, কোনো দেশের সরকার যদি নিজে থেকেই স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান বৈধ হয়ে যায়। এদেশে এবার সেটাই হয়েছে।
এ সরকারের বৈধতা কতদিন স্থায়ী হবে আমরা জানি না। এটি কোনো মেয়াদ নিয়ে বৈধতা লাভ করেনি। একটি কর্তব্য নিয়ে এসেছে। মানুষ আশা করেছে, বিগত সরকারের আমলে যেসব অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, এ সরকার তার পুনরাবৃত্তি করবে না। বিগত সরকার এবং নতুন সরকারের মাঝামাঝি টানাপোড়েনের সময়টা মোকাবিলা করেই এ সরকারকে এগোতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেক কাজ, যেটা আগের সরকারের কাজের পুনরাবৃত্তি মনে হতে পারে। আগের সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, ক্রসফায়ার হয়েছে। এ সরকারকে এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। অবশ্য এ সময়ে কিছুদিন যাবৎ ক্রসফায়ার বন্ধ আছে। তা যে ফিরে আসবে না, কীভাবে বলি?
বিগত সরকারের শেষ ২০-২২ দিনে দেশে যে পরিমাণ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এখনো তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায়নি। নিহতের সংখ্যা হাজারের বেশি বলে অনুমান। এ গুম, খুন, হত্যা বন্ধ করা এ সরকারের প্রধান কাজ। র্যাব এবং বিবিধ গোয়েন্দা সংস্থা মানুষকে যেভাবে ধরে নিয়ে যেত এবং বিনা বিচারে গুম করত, সেটা বন্ধ করতে হবে। মানুষকে অবাধে তার মত-দ্বিমত, পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করার অধিকার দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলীয় সরকার নয়। ছাত্র আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করেছেন তাদের সরকার। এ সরকার যদি জনগণের ম্যান্ডেট পালন না করেন, তার বিরুদ্ধেও মানুষ আবার রুখে দাঁড়াবে।
জনগণই সব ক্ষমতার উৎস-শুধু কথার কথা নয়, ২০২৪ সালে মানুষ বাস্তবেও তা প্রমাণ করেছে। আবার সেই মুক্তিযুদ্ধের আবহাওয়া ফিরে এসেছে। এজন্য বলব, মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিশ্রুতি থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব সরকার সরে গিয়েছিল, মানুষ সে অধিকার আবার ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে। আগেও মানুষ আন্দোলন করেছে, কিন্তু এবার তারা সফল হয়েছে। বিপদ কিন্তু কেটে যায়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবায়ন করা হবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না।
বর্তমান সরকার কি নির্বিঘ্নে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান : একটু আগেই বললাম, সরকারের অনেক বিঘ্ন আছে। একটা বিঘ্ন ভেতর থেকে। আরেকটা বিঘ্ন বাইরে থেকে। আগে বাইরেরটা বলি। বিগত সরকার পরাজিত হয়েছে সে সরকারের সমর্থকরা এখনো পরাজিত হয়নি। তারা দেশের সব জায়গায় আছে। তাদের কিছু লোক দেশের সামরিক বাহিনীতে আছে, পুলিশের মধ্যে আছে।
বিগত সরকার গত ১৫ বছরে দেশে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটা দুর্বৃত্ত-ধনিক শ্রেণি তৈরি করেছে। বলতে গেলে দেশে তোষামোদকারী, পা-চাটা, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, একটা জঘন্য পুঁজিপতি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তাদের হাতে বিপুল অর্থসম্পদ। তাদের দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব। এদের নিয়েই বিপদের আশঙ্কা। এটা এক নম্বর বিপদ। তারা যে কোনো সময়ই জনগণের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। তারা মনে করে, তাদের পরাজয়টা সাময়িক। কেউ কেউ বলছেন, ‘গতবার আওয়ামী লীগের ফিরতে ২১ বছর লেগেছিল, এবার ২১ মাসও লাগবে না।’
দ্বিতীয় বিপদ, প্রতিবেশী ভারতকে নিয়ে। বিগত সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশের বন্ধু বলে দাবি করেছিল; কিন্তু বাস্তবে কোনো বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়নি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য ভারত নানা কার্যক্রম চালাতে পারে। কেউ কেউ এ দেশে সামরিক অভিযান চালানোর উসকানি দিচ্ছে। ‘নর্থ-ইস্ট নিউজ’ বলে তাদের একটা নিউজ আউটলেট আছে, সেখানে জয়দীপ সাইকিয়া নামক এক ভদ্রলোক লিখেছেন, ভারতের উচিত সামরিক অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সেই সংবাদের শিরোনাম, ‘লেট আস রিটার্ন টু ঢাকা।’ এমন পরিস্থিতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের সামনে বাধার পরিমাণটা কী হতে পারে। অন্যান্য বাধা তো আছেই।