বিপ্লব না সংস্কার: কোন পথে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ কি কোনো বিপ্লবী অবস্থা পার করছে? প্রধান হুমকি কি প্রতিবিপ্লব ঠেকানো, নাকি স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা, নাকি দুটাই? আসল কথাটা হলো, বাংলাদেশে এখন কি বিপ্লবী নেতা দরকার, নাকি গঠনমূলক রাষ্ট্রনায়ক দরকার? প্রশ্নটা কিছুটা জটিল। কিন্তু ধৈর্য ধরে ফয়সালা না করা পর্যন্ত সফল হওয়া কঠিন।
প্রথম ফয়সালা হলো, বাংলাদেশ একই সাথে বিপ্লবী ও গঠনমূলক পর্ব পার করছে। বিপ্লবের প্রথম কাজ পুরোনো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে নতুন শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো। বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা শুধু এক দল বা সরকারের হাত থেকে আরেক দল বা সরকারের হাতে না, বরং এক শ্রেণির হাত থেকে আরেক শ্রেণির হাতে নিয়ে আসা। বিপ্লব পুরোনো মতাদর্শের দাপট গুঁড়িয়ে দেয়। নিয়ে আসে নতুন আদর্শের যুগ। বিপ্লবের এই ক্লাসিক্যাল সংজ্ঞা কতটা মেলে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির সাথে? এক এক করে বলা যাক।
বাংলাদেশে একটা অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের বল প্রয়োগের শক্তিকে যেভাবে পরাজিত করেছে, তার ধরন অবশ্যই বৈপ্লবিক। কিন্তু অভ্যুত্থানের নেতারা কিংবা তাদের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রকে ভাঙতে চান না। বরং রাষ্ট্র মেরামত, আরও সাহসী ভাষায় বললে, তারা রাষ্ট্রের পুনর্গঠন চান। রাষ্ট্র জনগণের হাতিয়ার হবে, সমাজের টুঁটি চিপে ধরবে না, লুটপাটের পাহারাদার ও ম্যানেজার হবে না, রাষ্ট্র স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেবে না– এটাই সবার চাওয়া।
যেহেতু আন্দোলনের নেতা কিংবা সরকার কেউই রাষ্ট্রের ধ্বংস চান না; যেহেতু বাজার অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের কোনো খুঁটিকেই তারা গুঁড়িয়ে দিতে চান না, সেহেতু এটা বিপ্লব নয়। বরং তারা চান রাষ্ট্রের সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনকানুনের শুদ্ধিকরণ। এই দিক থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ধরনটা মোটেই বিপ্লবী নয়। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে তারা সংহত করতে চান। সুতরাং জুলাই মাস থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টাই ছিল বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময়। সে সময় রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল, প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছিল, পুলিশ পরাস্ত হয়েছিল। এখন চলছে রাষ্ট্রের সংহতকরণ বা পুনর্গঠন পর্ব। এই পর্বের প্রধান কাজ তাই বেসামরিক সরকার ও প্রশাসনের সংহতকরণ। এটা বিপ্লব নয়, সংস্কার।
একই সাথে এটাও সত্য যে, পুরোনো ব্যবস্থা ও তার শক্তিমত্তা এখনও নিঃশেষিত হয়নি। কোনো রাজনৈতিক শক্তি কিংবা পরাশক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত হার মানে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা একেবারে নিঃশেষিত হয়। আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের পরেও, ৮ আগস্টে সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও অপতৎপরতা থামেনি। চোরাগোপ্তা হামলা, আন্তঃজেলা নৈশডাকাতি, ব্যাংক ও আদালতে কূটচাল সৃষ্টি, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে’ ঢাল বানিয়ে এক ঢিলে বহু পাখি মারা এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক পকেটে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে অস্বীকার করার মতো কাজ এখনও চলমান। এর অর্থ প্রতিবিপ্লবী শক্তি এখনও তাদের হারানো ক্ষমতা ফেরত পাওয়ার জন্য মরিয়া। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার, অস্থায়ী সরকার, ছাত্রজনতা এবং সামাজিক শক্তি একের পর এক এসব ষড়যন্ত্রের পর্দা ছিন্ন করে সফল হচ্ছে। বলা হতো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে দেশে প্রতিহিংসার রক্তবন্যা বয়ে যাবে, রাষ্ট্র মুখ থুবড়ে পড়বে, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। প্রতিহিংসা গোড়াতেই থামানো গেছে। সড়ক ও জনপথের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছাত্র-জনতা নিয়েছে। এমনকি পুলিশশূন্য দেড় সপ্তাহে অপরাধের হার পুলিশি রাষ্ট্রের সময়ের ১ শতাংশও ছিল না। বিচ্ছিন্ন নাশকতা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন করার চেষ্টাও পরাজিত হয়েছে। সরকার, সেনাবাহিনী ও জনগণের অসম্ভব দারুণ একটা সমন্বয়ও আস্থা ফেরাতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এখনও সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্রের মজুত রয়েছে, তাদের নেতাদের হাতে রয়েছে বিপুল অর্থের পাহাড় এবং তাদের দেশবিরোধী নেটওয়ার্কও কিছুটা টিকে আছে।