বাংলাদেশকে ভারতের বুঝতে হবে
এম হুমায়ুন কবীর। কূটনীতিক ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি বর্তমানে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রদের গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। আলোচনা হয় শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন নিয়েও।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পালাবদলকে কীভাবে দেখছেন। বিশেষ করে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হলো।
এম হুমায়ুন কবীর: ছাত্রদের নেতৃত্বে যে গণ-আন্দোলন হলো, সেটা ছিল অভূতপূর্ব ও অসাধারণ এক ঘটনা। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনটি শুরু হলেও পরবর্তীকালে এটি রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে যায়। সরকারের একের পর এক ভুল পদক্ষেপ ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ফলে গণবিস্ফোরণ ঘটে। ছাত্রদের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। অনেকে এটিকে বিপ্লব ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ছাত্ররা শুধু সরকারের পরিবর্তন চায়নি, তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছে।
অন্যান্য আন্দোলন থেকে এর পার্থক্যটা কী?
এম হুমায়ুন কবীর: আগের বেশির ভাগ আন্দোলন হয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। সেখানে ক্ষমতার পরিবর্তন মুখ্য বিষয় ছিল। এবার যে তরুণেরা আন্দোলন করেছেন, তাঁরা আদর্শবাদী। তাঁরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি সামনে এনেছেন। জনগণ এটা সমর্থন করেছে। দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, সামাজিক বৈষম্য ও দুর্নীতিই মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ভবিষ্যৎ-মুখী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তাঁরা। যার মূল লক্ষ্য সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আমি তাঁদের স্বাগত জানাই।
বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী? আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতসহ সব দেশই নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে অন্য কিছু আছে কি না?
এম হুমায়ুন কবীর: সব দেশের প্রতিক্রিয়া তো এক রকম হবে না। হয়ওনি। যেসব দেশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল, তারা কিছুটা হতবাক হয়েছে। গত কয়েক দিনে ভারতের কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও টেলিভিশন আমার মতামত জানতে চেয়েছে। আমি তাদের বলেছি, এটা ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যাতে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল। কিন্তু ভারতীয় বন্ধুদের বেশির ভাগই এটা মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, এর পেছনে পাকিস্তানের আইএসআই, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র আছে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ছাত্রদের এই আন্দোলন ছিল একটি অনন্য ঘটনা। তিউনিসিয়া ও মিসরে যা হয়েছে, সেটা যদি আরব বসন্ত হয়, আমাদের এখানে সত্যিকার বাংলা বসন্ত হয়েছে। আর চীনের কথা বলা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে তো শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু এই আন্দোলনে তাদের হস্তক্ষেপের তো প্রমাণ নেই।
ভারতের প্রধান আপত্তি কোথায়?
এম হুমায়ুন কবীর: এখানকার জনগণ যে গণ-আন্দোলন করে সরকারকে হটাতে পারে, সেটা ভারতীয়রা বুঝতে চান না। তাঁদের কাছে এটা স্বর্গপতন। এ বিষয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামও এনডিটিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ৫৩ বছর আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের শক্তি সম্পর্কে তাঁদের ধারণা নেই। প্রতিটি দেশই জাতীয় স্বার্থের নিরিখে তার পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের যেমন নিজস্ব কৌশল আছে; চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশগুলোরও নিজস্ব কৌশল থাকবে। আমি মনে করি, ভারতের যেটা প্রধান উদ্বেগ নিরাপত্তা, সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যাতে তারা ঝুঁকিতে পড়ে। আবার বাংলাদেশের যেসব ন্যায্য দাবি, সেগুলোর বিষয়েও ভারতকে সংবেদনশীল হতে হবে। যেমন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ককে তাদের নেতিবাচকভাবে দেখা ঠিক হবে না। এটা করলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনকে ভারতের দিক থেকে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের অনুভূতিকে তারা মর্যাদা দেবে আশা করি।