প্রতিপক্ষ বানানোর আত্মঘাতী রাজনীতি
কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত সহিংসতার পথেই যাত্রা শুরু করেছে। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্দয়ভাবে হামলা চালায়। এ হামলায় অনেকে আহত হয়। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের হামলার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে সরকারের ভূমিকা নিয়ে। আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে সরকার কেন এমন নির্দয় হয়ে উঠল? প্রতিবাদ-আন্দোলন কি দেশে নিষিদ্ধ? কেউ কোনো দাবি উত্থাপন করতে পারবে না, আন্দোলন করতে পারবে না? সরকার কি তাই চায়? আর ছাত্রলীগের কাজ কি মেরে-পিটিয়ে আন্দোলন দমন করা? এটা কি কোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের নমুনা? কোথায় আইনের শাসন? কোথায় নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার— বাক-স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার অধিকার?
ছাত্রলীগের কর্মীরা হেলমেট পরে, লাঠি-সোটা হাতে প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা পরিচালনা করেছে, শত শত শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। অথচ, পুলিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। বরং তারা ছিল আক্রমণকারীদের সহযোগীর ভূমিকায়, কোথাওবা নীরব দর্শক। পুলিশের এই ভূমিকা জনমতে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
সোমবারের হামলা ও সংঘর্ষের পর আজও পথে নেমেছেন আন্দোলনকারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসগুলোতে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা থাকলেও ঢাকার বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নেমে পড়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডেকেছে আন্দোলনকারীরা ও ছাত্রলীগ। আরও সংঘাতের আশঙ্কা তাই থেকেই যাচ্ছে।
কয়েকদিন ধরেই কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। ক্ষমতাসীন দলের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতি কটাক্ষ ও হুঁশিয়ারি শোনা যাচ্ছিল। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছিলেন। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল। এমন এক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এক গণমাধ্যমকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিদের জন্য কোটা থাকবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিদের জন্য থাকবে?’ বলে মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য আন্দোলনকারীদের ক্ষুব্ধ করে। ‘প্রধানমন্ত্রী প্রকারান্তরে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেছেন’ এমন একটা ধারণা আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সারারাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’—এই বলে স্লোগান দেয়। এতে করে আন্দোলকারীদের প্রতি ক্ষমতাসীন মহলের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। শুরু হয় সমালোচনা। প্রবল সমালোচনার মুখে আন্দোলনকারীরার জানান যে, তাদের স্লোগানটা ছিল এরকম: ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে স্বৈারাচার স্বৈরাচার।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া স্লোগানসম্বলিত বেশিরভাগ ভিডিওক্লিপিংয়ে অবশ্য ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ এই কথাটাই বার বার উচ্চারিত হতে দেখা গেছে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাদের নামে ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগানোর জন্যই স্লোগানটা সংক্ষিপ্ত করে প্রচার করা হয়েছে। যদিও এটা কোনো শক্ত যুক্তি নয়। ‘রাজাকার’ শব্দটি আমাদের দেশে অত্যন্ত ঘৃণ্য হিসেবে পরিগণিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নৃশংসভাবে হত্যায় সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর লুটপাট করেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ ও অত্যাচার করেছে, তারাই রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। এই যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচারের দাবিতে এক সময় গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বে দেশের ছাত্র-যুবাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের অগণন মানুষ একাট্টা হয়েছিল। প্রবল গণদাবির মুখে শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের সর্বোচ্চ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
এই দেশে কোনো বিবেচনাতেই ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’—এই স্লোগান উচ্চারণের কোনো সুযোগ নেই। এর সামনে কিংবা পেছনে আর যাই থাকুক না কেন। এটা সরাসরি দেশকে, দেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান। যতই বলা হোক যে, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে নিজেদের রাজাকার বলেছেন, এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। কেউ যদি ব্যঙ্গ করেও যদি নিজেকে রাজাকার হিসেবে পরিচিত করাতে চায়, তার মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম নিয়ে তবু প্রশ্ন থাকবে। কোটা আন্দোলনকারীরা এই স্লোগান উচ্চারণ করে মোটেও ঠিক কাজ করেনি।