ব্যাখ্যা করলে অন্য অর্থ বেরোয়
গত ২৩ জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে বলেই বারবার জনগণ ভোট দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দুইভাগে পর্যালোচনা করতে চাই। প্রথম ভাগের পর্যালোচনার বিষয় ‘বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।’ ‘গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকা’ নিয়ে পর্যালোচনা থাকছে দ্বিতীয় ভাগে।
এটা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার, যেটি স্বাধীন বাংলাদেশেরও প্রথম সরকার, তাদের সাড়ে তিন বছরের (১৯৭২-৭৫) মেয়াদকালে জাতীয় জীবনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয় দলটি। এ সরকারের আমলে রচিত হয় দেশের সংবিধান, যা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়। এ সরকারের আমলে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান একটি প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় সরকারে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার গঠিত সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটির অন্তর্বর্তীকালীন সুপারিশ অনুযায়ী প্রাদেশিক সচিবালয়কে জাতীয় সচিবালয়ে রূপান্তর করা হয়।
সরকারের নীতি, পরিকল্পনা ইত্যাদি বাস্তবায়নের জন্য কিছুসংখ্যক সংযুক্ত দপ্তর, অধস্তন অফিস এবং স্বশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো এবং বেসামরিক চাকরি পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের নীতি কী হবে, তা নির্ধারণে গঠিত হয় ‘প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ কতিপয় উচ্চাভিলাষী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হলে প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রথমে প্রধান সামরিক প্রশাসকের এবং পরে রাষ্ট্রপতি পদেরও দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যা সংক্ষেপে বিএনপি নামে পরিচিত। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। জিয়াউর রহমানের একটি অনন্য অবদান পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনর্বহাল।
জিয়াউর রহমান নিয়োগকৃত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশের আলোকে বিএনপি সরকার ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন)’ আদেশ জারি করে। এতে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৪টি সার্ভিস ক্যাডার। তবে ক্যাডারগুলোর প্রতিটির একাধিক সাব-ক্যাডার থাকায় মোট ক্যাডারের সংখ্যা বাস্তবে দাঁড়ায় ২৮টিতে। গত ৪৪ বছরে দু-একটি ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন/সংশোধনসহ ১৯৮০ সালে বিএনপি সরকার প্রবর্তিত সিভিল সার্ভিস কাঠামো এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।
বিএনপির সরকার পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির করে। অর্থনৈতিক নীতিতে বেসরকারি খাতের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি। এটির শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমান নেতৃত্বাধীন বিএনপির শাসনামলে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সফর করে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের শাসনামলে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) জিয়াউর রহমানের প্রচেষ্টার ফসল।
জেনারেল এইচএম এরশাদ সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে নয় বছর (২৪ মার্চ ১৯৮২ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) দেশ শাসন করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিনি প্রশাসনিক সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। ‘মার্শাল ল কমিটি’ এবং ‘প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি’ নামে দুটি কমিটি গঠিত হয়। মার্শাল ল কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং এর অধীন বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরগুলোর জনবল কাঠামো, যানবাহন ও অফিস ইকুইপমেন্ট ইত্যাদির সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রশাসনের এসব খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অপচয় বহুলাংশে কমে আসে। এসব অফিসে জনবল কাঠামো, যানবাহন ও অফিস ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি পুনর্নির্ধারণে এখনো উপর্যুক্ত ‘মার্শাল ল কমিটি’ অনুমোদিত কাঠামোকে মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।