প্রাকৃতিক ও ‘অতিপ্রাকৃতিক’ দুর্যোগগুলো
এক দুর্যোগপূর্ণ পৃথিবীতে এখন আমাদের বসবাস। এই দুর্যোগ প্রধানত প্রাকৃতিক। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বেহিসাবি কর্মকাণ্ডের কারণেও দুর্যোগ নেমে আসে। তবে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি প্রভৃতিও মানুষের জন্য অপরিসীম দুর্ভোগ এবং মানবিক সংকট সৃষ্টি করে দুর্যোগ। এ ছাড়া আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রও সৃষ্টি করছে নানা রকম দুর্যোগ। এগুলোর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোনো সংস্রব নেই। এই শ্রেণির দুর্যোগকে আমি বলেছি, ‘অতিপ্রাকৃতিক’; অর্থাৎ প্রকৃতিবহির্ভূত। রাষ্ট্রক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় রাজনীতির প্রশ্রয়ে ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী হয়ে ওঠা কিছু মানুষ এই অতিপ্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি করে চলেছেন। এই শ্রেণির দুর্যোগের সংখ্যাও এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বাড়ছে মানুষের আস্থাহীনতা, হতাশা।
প্রথমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথায় আসি। এই পৃথিবীর সব প্রাণ প্রকৃতিরই সন্তান। এর মধ্যে মানুষ হচ্ছে একমাত্র, যারা নিজেদের কৃতকর্ম দিয়ে অনবরত প্রকৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে বেজায় বৈরী করে তুলছে। এই বৈরিতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে কোনো কোনো বিজ্ঞানী ধারণা করছেন, পৃথিবীর পরিবেশ-প্রতিবেশ আর প্রাণধারণের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে ঋতুর বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য লোপ পাবে।প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে দুর্যোগের প্রচণ্ডতা (ইনটেনসিটি)। জনদুর্ভোগ বাড়বে। এভাবেই আমাদের এই গ্রহ পৌঁছে যাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
কয়েক দিন আগে হয়ে গেল ঘূর্ণিঝড় রিমাল—এ ধরনের একেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপুল সম্পদ বিনষ্ট এবং অসংখ্য মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। ওই ঝড়ে বিধ্বস্ত বাড়িঘর কত দিনে এবং কতখানি পুনর্নির্মাণ সম্ভব হবে, তা অনিশ্চিত। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা সব এলাকায় পুনঃস্থাপন করা এখনো সম্ভব হয়নি। অথচ বিদ্যুৎকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট-সেবা সবই এখন পর্যন্ত অচল।
রিমালের মতো ঘূর্ণিঝড় যে আমাদের দেশে নতুন হলো, তা নয়। তারপরও এ ধরনের ঝড়ের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। এই যে এবার অস্বাভাবিক গরম এবং একটানা প্রায় মাসব্যাপী তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া; কালবৈশাখীর স্বল্পতা, দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টি, এগুলোও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফল বলে মনে করা হয়। তবে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’-এর মতো সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে দায়ী করা এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের দায় নগণ্য বলে দায়িত্ব শেষ করা সঠিক নয়। কারণ আমাদের দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি আমরা নিজেরাই করেছি এবং করে চলেছি। বায়ু-পানি-মাটিদূষণ এবং বনাঞ্চল উজাড় করার মতো ভয়াবহ পরিবেশবিধ্বংসী কাজে পৃথিবীতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। এ বিষয়ে তথ্যভিত্তিক কোনো সমীক্ষা হলে পৃথিবীতে আমাদের দেশের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়েই থাকবে। কাজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব আমাদের ওপর একটু বেশিই পড়ছে এবং পড়বে।
এই একই কথা বলা যায়, ‘অতিপ্রাকৃতিক’ দুর্যোগগুলোর বিষয়েও। এই শ্রেণির দুর্যোগের মধ্যে প্রধান হলো দুর্নীতি। আমাদের ও রাষ্ট্রের জন্য এখন সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হয়ে উঠেছে দুর্নীতি। একসময় একটানা কয়েক বছর আমরা বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে শীর্ষস্থানে ছিলাম। এরপর ওই সূচক অনুযায়ী, আমাদের অবস্থান কিছুটা উন্নত হলেও বাস্তবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গণমাধ্যম কিছুদিন পরপরই এমন একেকটি দুর্নীতির ঘটনা জনসমক্ষে উপস্থাপন করে, যা অভাবনীয়, অচিন্তনীয়। যেমন এখন জনসমক্ষে আছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির কাহিনি।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ছোট্ট ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করি। বেনজীর আহমেদকে আমি প্রথম যখন দেখি, তিনি তখন পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার (এসি)। প্রয়াত সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তখন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী। তিনি এলজিইডিতে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন ঢাকার নগর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। নগর ব্যবস্থাপনায় আইনশৃঙ্খলা ছাড়াও ট্রাফিক এবং অন্য আরও কিছু বিষয়ে পুলিশের বিশেষ ভূমিকা থাকে বলে ওই সেমিনারে পুলিশ বিভাগেরও (ডিএমপি) অংশগ্রহণ ছিল। পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে সেখানে গিয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ। আমি সেখানে আমন্ত্রিত ছিলাম সংবাদকর্মী হিসেবে। ওই সেমিনারে বেনজীর আহমেদের উপস্থাপনা, বক্তব্য, তাঁর শারীরিক ভাষা প্রভৃতি দেখে পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আমার খুব উচ্চ ধারণা হয়েছিল, যা এখনো আছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ
- মানবিক সঙ্কট