ডলার বাজার ও রিজার্ভ স্থিতিশীলতার পথ খানাখন্দময়
দেশে ডলারের দাম ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার প্রভাব নিয়ে আলোচনা হতেই পারে; কিন্তু এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আইএমএফ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সরকারের নীতি-কৌশলের বাইরে কিছু হয়নি। ক্রলিং পেগ থেকে ডলারের বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার দিকেও এগোচ্ছে সরকার। কিছু বিশেষজ্ঞ এমনও বলছেন, আরও আগেই এ পদ্ধতিতে যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে ডলারের ‘আনুষ্ঠানিক দাম’ একবারে ৭ টাকা বাড়াতে হতো না। বৃদ্ধির হারটা বেশিই হয়েছে।
খোলাবাজার তো বটেই; ব্যাংকেও যে দামে ডলার বেচাকেনা হচ্ছিল, তার কাছাকাছি একটা দামই নির্ধারণ করা হয়েছে। এও বলে দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক সেখান থেকে সামান্য এদিক-সেদিক করতে পারবে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে দেখে খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা দিয়েছিল আরও বাড়িয়ে। এতে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও সেটা স্থায়ী হয়নি অবশ্য। নির্ধারিত দামের চেয়ে আরও ৭-৮ টাকা বেশিতে ডলার বিক্রি বন্ধ হয়েছে। খোলাবাজারে দাম কিছুটা বেশি থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে ৭-৮ টাকা বেশি দাম বোধ হয় বাস্তবসম্মত নয়, অন্তত এ মুহূর্তে। এর বড় কারণ, ব্যাংক খাতে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। ‘যথেষ্ট’ বিবেচিত না হলেও পরিমাণটা আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক খোলাবাজারের ব্যবসায়ীদের ডেকে বলে দিয়েছে, তারা যেন নির্ধারিত দামের বড়জোর এক টাকা বেশিতে ডলার বেচে। বেশি দামে বেচতে না পারলে তারা বেশি দামে কিনতেও পারবে না। ব্যাংকের বেলায়ও কথাটা প্রযোজ্য। রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলার ব্যাংক কিনবে ১১৭ টাকার সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ করে। ব্যাংকও আগে রেমিট্যান্সে সমপরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারত। এখনও যে ‘প্রয়োজনে’ প্রণোদনা একেবারে দেবে না, তা নয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা তাহলে ১১৮ টাকায় ডলার কিনবে কীভাবে?
এদিকে সরকার কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলারের ওপর চাপ কমাতে চাইছে অনেক দিন ধরে। এ কারণে ভোগ্যপণ্যের আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। মেশিনারিজ আর কাঁচামালের আমদানি কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ওষুধের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সামগ্রীর আমদানি হ্রাসের খবরও মিলছিল। মাসের পর মাস এভাবে চলার ফলে আমদানিতে ডলারের চাহিদা স্বভাবতই কমেছে। এ সময়ে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স উৎসাহজনকভাবে না বাড়লেও আমদানি কমায় পরিস্থিতি হয়েছে কিছুটা কম উদ্বেগজনক। আমাদের রপ্তানি খাতও যেখানে আমদানিনির্ভর, সেখানে আমদানি কমলে অর্থনীতি আবার সংকুচিত হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থান ও আয়ে। ডলার সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে এ সর্বনাশ করতে হয়েছে নিজ হাতেই।
সামনে কোরবানির ঈদ। এই সময়ে রমজানের মতো ভোগ্যপণ্যের আমদানি অবশ্য হবে না। মসলাও যেটুকু আসার, তা সম্ভবত ইতোমধ্যে এসে গেছে। দাম বেশি পড়ে যাওয়ায় সংকট থাকলেও পেঁয়াজ আমদানি খুব বাড়বে না। আর কোরবানির গরু-ছাগলে আমরা তো স্বয়ংসম্পূর্ণ। বোরোর ফলন কেমন হবে, তা এখনও অস্পষ্ট। এটা মার খেলে অবশ্য দ্রুতই চাল আমদানিতে নামতে হবে। এতে ডলারের চাহিদা বাড়লেও বাড়বে আগামী অর্থবছরে। এ অবস্থায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে উঠবে সরকারি আমদানিতে। প্রাথমিক জ্বালানি ও সারের মতো জরুরি পণ্য আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। সরকার তো বিদ্যুৎও আমদানি করছে। আর এসব খাতে রয়েছে অনেক বকেয়া। নতুন আমদানিতেও লাগবে ডলার। এর দাম বাড়ানোয় সরকারকে এখন ১১৭ টাকাতেই ডলার কিনতে হবে। এটা আগের দামে থাকলে আমদানি বাবদ সরকারের ব্যয় অন্তত বাড়ত না। এর মধ্যে বিশ্ববাজারে কিছু জ্বালানির দাম কমে আসায় তাতেও কিছুটা সাশ্রয় হতো। বিদেশি ঋণ পরিশোধেও এখন লাগবে বেশি স্থানীয় মুদ্রা। সরকারের হাতে তো স্থানীয় মুদ্রাও বেশি নেই। এ অবস্থায় এমনকি উচ্চ সুদে বন্ড ছেড়ে নিতে হচ্ছে ঋণ।
ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১৭ টাকা হওয়ায় বেসরকারি খাতের তেমন সমস্যা অবশ্য নেই। কেননা, তারা এমন দামেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশিতে ডলার কিনত। এ অবস্থা বহাল থাকলে তাদের হাতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার কথা নয়। আমাদের পণ্যবাজারের কিছু বিকৃতির কথা অবশ্য ব্যাপক আলোচিত। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ‘সিন্ডিকেট’ থাকার কথা স্বীকার করেন। আর বাজার তো শুধু আমদানি ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। ক্রমবর্ধমান পরিবহন ব্যয় আর পণ্যের বহু ধাপ হাত বদলের মতো বিষয় এ ক্ষেত্রে রয়েছে। কিছু পণ্যসামগ্রী আবার দেশে এনে পরিশোধন কিংবা সংযোজন করা হয়। সে ক্ষেত্রে রয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারের বিষয়। এ জন্য ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এগুলোরও ‘নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ’ নিশ্চিত নয়। সরকারের দিক থেকে আবার সংকেত রয়েছে– এসবের দাম আরও বাড়বে। ডলারের বর্ধিত দামে সরকার আমদানি করবে বলে অচিরেই হয়তো বাড়বে ডিজেলের দাম। এর দাম এখন মাসে মাসে ‘সমন্বয়’ করা হচ্ছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আমদানি
- কোরবানির ঈদ
- ডলারের দাম