অর্থনীতির সংকট কতটা কেটেছে
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সম্প্রতি প্রাক্-বাজেট আলোচনায় বলেছেন যে দেশের অর্থনৈতিক সংকট কেটে গেছে। সিপিডি এক আলোচনায় বলেছে যে অর্থনীতি গভীর সংকটে নিমজ্জিত। তাদের ভাষ্যে, এ রকম সংকট আগে দেখা যায়নি। এ ধরনের বিপরীতমুখী দাবির মাঝখানে পড়ে আমজনতার অবশ্যই কৌতূহল থাকবে যে আসলে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। সংকট কেটে গেছে—এটি যেমন ঠিক নয়, বর্তমানের সংকট সবচেয়ে ভয়াবহ—এ রকম বক্তব্যও মেনে নেওয়া একটু কঠিন।
প্রথমত, অর্থমন্ত্রীর কথার আক্ষরিক অর্থ ধরলে আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই এবং এখন থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক চলবে। এটি সত্য নয়। কদিন পরে তাঁর বাজেটের আয়তন দেখলেই টের পাওয়া যাবে। এবারের উন্নয়ন বাজেটে যেসব সংকোচনের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে প্রবৃদ্ধির লাগাম টানবে, যা আগে করা হয়নি। বাজেটের আগে মনোবল চাঙা করার জন্য অর্থমন্ত্রী এ রকম দাবি করেছেন।
অন্যদিকে সিপিডিসহ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ সংকটের যে পূর্বাভাস দিচ্ছেন, তাকে সরাসরি ‘অদেশপ্রেমিক’ আচরণ বা ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভীতিসঞ্চারক’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। দেশপ্রেম শুধু রাজনীতিবিদদেরই আছে, অর্থনীতিবিদদের ওই জায়গায় ঘাটতি রয়েছে—সে রকম কোনো প্রমাণ কোনো দেশে পাওয়া যায়নি। সংকট যে কিছুটা কেটেছে, তা সত্যি। সেটি ঘটানো হয়েছে কিছুটা আত্মঘাতী পথে—আমদানি কমিয়ে। বিশেষত মূলধনি সামগ্রীর আমদানির গলা টিপে ধরে অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা কমানো হয়েছে।
যে দেশের এখন শতকরা ৮-৯ জাতীয় প্রবৃদ্ধি নিয়ে নীতিমালা সাজানোর কথা, সে দেশ এখন মাত্র সাড়ে ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি পেয়েই ধন্য। এই অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্বে এলসি সেটেলমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি উভয় ক্ষেত্রেই কমানো হয়েছে শতকরা ২৫ ভাগ, যা স্বল্প মেয়াদে প্রবৃদ্ধি কমাবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির সক্ষমতাকে নিচে নামাবে। এটি আসন্ন সংকট।
গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে তাঁর কর্মজীবনে অর্থনীতিতে এর চেয়ে বড় সংকট আর দেখেননি। আরও বলেছিলেন যে এর চেয়ে তলানিতে যাওয়ার আর পথ নেই। গত নভেম্বর থেকে এই পাঁচ মাসে অর্থনীতিতে এমন কোনো গুণগত বা পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে যায়নি, যার ওপর ভিত্তি করে বলা যাবে যে অর্থনীতি–সংকট কেটে গেছে।
উৎকণ্ঠার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রিজার্ভ-সংকট। সেটি গত পাঁচ মাসে কোনোই উল্লেখযোগ্য উন্নতিতে যায়নি। গত অক্টোবরের শেষে নেট রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, মার্চের শেষে সেটি ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিপিএম৬ অনুযায়ী যদিও ২৭ মার্চের রিজার্ভ পজিশন দেখানো হচ্ছে ১৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার, সেটি নিকটতম সময়ে দায় পরিশোধের পর কত দাঁড়াবে, তা বলে দেয়নি। কদিন পরে আইএমএফের দলবল বেড়াতে এলে এই নেট পজিশন পাওয়া যাবে। আইএমএফ এই সময়ে যে রিজার্ভ পজিশন রাখতে বলেছিল, তার চেয়ে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়ে গেল। এতেও আইএমএফ পরের কিস্তি অবশ্যই দেবে, কিন্তু সংকট কেটে গেছে, এমন সনদ ওরা প্রদান করবে না।