ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব ও ক্ষমতাকেন্দ্র
ঘটনা ১: আমি একজনকে চিনি, যার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ না থাকলেও তিনি ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের ধারক ও বাহক। ছাত্র জীবনে সরকারি ছাত্র সংগঠন করতেন। একজন নারী সহকর্মীর পিঠে একটা ট্যাটু দেখে তিনি তার পুরুষ সহকর্মীর কাছে অত্যন্ত অকথ্য এক মন্তব্য করেছিলেন। মন্তব্যটা স্বভাবতই ধর্ষকামীর! তার বিরুদ্ধে কিছু করা যায়নি৷ কেননা, তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানের শক্তিমানদের অনুগত প্রমাণ করে ফেলেছেন ততদিনে এবং সেই শক্তির বলেই চলেছেন। শক্তিমানের পৃষ্ঠপোষকতার শক্তি কত ভয়ংকর, ভাবা যায়!
ঘটনা ২: আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। পড়ালেখার প্রায় শেষ দিকে। আমাকে এক সহপাঠী বলল, কী রে জাহাঙ্গীরনগরে পড়িস, তোর প্রেম-ট্রেম নিশ্চয়ই অনেকগুলো হয়েছে! আমি বললাম, কেন? জাহাঙ্গীরনগরে পড়লেই বুঝি অনেক প্রেম হয়! সে বলল, জঙ্গলেই তো মঙ্গল। আমি তার সঙ্গে আর কথা বাড়াইনি। সেই সহপাঠী পরে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে।
ঘটনা ৩: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের কী অবস্থা তা তো আপনারা জানেনই। এটা তাই ঠিক সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনা নয়। ছেলেদের হলগুলোতে নবাগতদের বড়রা প্রশ্ন করে: ‘তোর ব্যাচে সবচেয়ে বড় বুক কার?’ নবাগতদের অধিকাংশ স্বভাবতই লজ্জা পায়। যে যত বেশি লজ্জা পায়, তাকে তত বেশি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। নবাগত চুপচাপ থাকলে তার জন্য বেনিফিট অব ডাউট হলো: ‘পরের দিন বুক মাইপা আইসা রাইতের বেলা এত নন্বর রুমে দেখা করবি। নাইলে খবর আছে কইলাম!’ এবং ফি-বছর এ চর্চা চলতেই থাকে।
পাঠক মনোরঞ্জনের জন্য সবচেয়ে খারাপ খবর এই যে, এসব ঘটনা শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে এমন না, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্রই ঘটে। ফলে এসব ঘটনার কোনো ‘একক শাখা’ নেই!
২.
আজকে আবারও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ধর্ষণের ঘটনা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। ছাত্রলীগ যতটা না, জাহাঙ্গীরনগর ততটাই বেশি। ছাত্রলীগ এখন চাইলেই বলতে পারে, অভিযুক্ত মুস্তাফিজ সহি ছাত্রলীগার না, বহিরাগত অনুচর৷ অতীতে এমনটা বলেছে বৈকি! কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সুযোগ নেই। এই ছাত্র লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগরে সে ঢুকেছিল মেধাবী ছাত্র হিসেবে, বের হলো ধর্ষক ছাত্রনেতা হিসেবে! একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এ যে কত বড় লজ্জার! জাহাঙ্গীরনগরের জন্য মুশকিল হলো, যা কিছু হারায় গিন্নির কাছে ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ সাব্যস্ত হয়ে যায় কিংবা হয়ে ওঠে ‘নন্দ ঘোষ’! অথচ, ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু জাহাঙ্গীরনগর হলেও, ঘটক যে ছাত্রলীগের নেতা এবং এসব যে সারাদেশেই তারা ঘটায়, সেটা বলার মতো কাণ্ডজ্ঞান সমালোচকদের বিন্দুমাত্র আছে বলে মনে হয় না!