দেয়াললিখন ও তৎসংক্রান্ত রাজনীতি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা ডালপালা মেলেছে। নতুন ঘটনা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের বাইরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়ালচিত্র মুছে তার ওপর ধর্ষণবিরোধী দেয়ালচিত্র অঙ্কনের অভিযোগে দুই বাম ছাত্রনেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এহেন আচরণকে অনেকেই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তথা ছাত্রলীগের প্রতি উস্কানিমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর চিত্র মুছে ফেলার বিষয়টিকে জাতির পিতার অবমাননা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। তবে পুরো বিষয়টিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতাকে লালন করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান।
মনে পড়ে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দেয়ালে জাতির পিতার এক বিশাল চিত্র আঁকা হয়েছিল, জানি না সেটি এখনও আছে কিনা বা থাকলেও কী অবস্থায় আছে। তবে যারা সেই দেয়ালচিত্রটি এঁকেছিলেন, সেই দলে আমার কাছের বন্ধুও থাকায় দারুণ তৃপ্তি বোধ করেছিলাম, এখনও করি। কিন্তু নতুন কলাভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত দেয়ালচিত্র মুছে ফেলার ঘটনাটির বিরুদ্ধে যেরূপ সরল বয়ান তৈরির প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে একমত হওয়া আসলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার শামিল। ফলে এটি বিপজ্জনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের যে স্থানে ওই দেয়ালচিত্রটি ছিল, স্মৃতি ঘাটলে দেখা যাবে ২০১৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে চলমান আন্দোলনের সময় ঠিক সেই স্থানে দিনের আলোয় একটি ক্যারিকেচার এঁকেছিল সে সময়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সেই ক্যারিকেচারটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের বাস্তবতাতেই নানাভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল না, বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক যুগের শিক্ষক রাজনীতির সিলসিলার এক দারুণ রূপায়নও ছিল।
তবে সেই সময়ের আন্দোলনটি কিছুটা থিতু হওয়ার খুব অল্প সময়ের ভেতর মুজিব শতবর্ষকে উপলক্ষ করে সেই ক্যারিকেচারটির ওপর হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত দেয়ালচিত্রটি আঁকা হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্রটি কারা এঁকেছেন তার কোনো উল্লেখ ছিল না। ফলে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে আগের ক্যারিকেচারটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন সামনে আসতে পারে।
তবে উপলক্ষ যা-ই হোক, কিছুদিন ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমতের প্রকাশ হিসেবে দেয়াললিখন ও দেয়ালচিত্রগুলোর কণ্ঠরোধ করার জন্য এহেন বিরোধী লিখন বা চিত্রের ওপর বঙ্গবন্ধু বা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কিত দেয়ালচিত্র এঁকে দেওয়া বা কিছু লিখে দেওয়া বেশ সাধারণ একটি প্রবণতা হিসেবে সামনে এসেছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র মুছে তার ওপর অন্য যে কোনো চিত্রাঙ্কন বা দেয়াললিখনকে খুব সহজেই জাতির পিতার অবমাননার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।