অর্থনীতির ক্ষত ও নতুন অর্থমন্ত্রীর করণীয়
১১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে শপথ গ্রহণকারী নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে অভিনন্দন ও শুভকামনা। মাহমুদ আলী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একজন সূর্যসন্তান, যিনি পাকিস্তানের কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে বিএ অনার্স ও এমএ পাস করে ওই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মেধাভিত্তিক ‘সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। তার মতো কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সাহসী সিদ্ধান্ত সারা বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাই তখন থেকেই তিনি আমাদের কাছে ‘সূর্যসন্তানের’ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে রয়েছেন। কূটনীতিক হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, সেগুলো আমার আলোচনার বিষয় নয়। কূটনীতিকের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০১ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। তার মন্ত্রিত্বকালেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছিল। ২০১৯ সাল থেকে পাঁচ বছর ধরে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় তার মেধা ও অভিজ্ঞতাকে নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেছেন। অতএব আমরা সর্বান্তঃকরণে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাফল্য কামনা করছি।
বিজয় অর্জনের ৫২ বছর পার করে এসে ২০২৪ সালে আমাদের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অর্জনগুলো নিয়ে আনন্দের বন্যায় ভাসার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের সদ্যসাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অদক্ষতার কারণে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অর্থনীতি অনেকগুলো বিপজ্জনক সংকটে নিমজ্জমান, যেগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখুন: অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা, মারাত্মক ডলার সংকটের কারণে আমদানি এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ টাকা থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১২৫ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশী টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৮ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং ও রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংক ঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। এ সমস্যাগুলোর প্রত্যেকটিই যেকোনো দেশের অর্থমন্ত্রীর ঘুম হারাম করার জন্য বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের সদ্যসাবেক অর্থমন্ত্রীর কাছে এ সমস্যাগুলো সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ‘কুসুমাস্তীর্ণ’ মনে হচ্ছিল! কারণ দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের ইতিহাসে অর্থনীতি সম্পর্কে এত স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন কোনো অর্থমন্ত্রী অতীতে কখনই আমরা পাইনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং পুরো মন্ত্রিসভার টিমওয়ার্কের মাধ্যমে নতুন অর্থমন্ত্রীকে ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো অবিলম্বে মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। সবার আগে নজর দিতে হবে ডলারের দাম বৃদ্ধি থামিয়ে দিয়ে টাকার ২৮ শতাংশ অবচয়নের ফলে উদ্ভূত মারাত্মক মূল্যস্ফীতি সমস্যার লাগাম টেনে ধরার দিকে। একই সঙ্গে নজর দিতে হবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে রুখে দেয়ার দিকে। বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি মোতাবেক ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, নিট রিজার্ভ নেমে এসেছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। গত ১২ ডিসেম্বর আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৯ কোটি ডলার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ কয়েক দিনের জন্য ২১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা মেটানোর পর রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে গেছে। বলা বাহুল্য, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি মোতাবেক ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল সেখান থেকে সোয়া দুই বছরে রিজার্ভ এত দ্রুত কমে যাওয়া অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট ডেকে এনেছে। (অবশ্য আইএমএফ কখনই ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের হিসাবকে গ্রহণ করেনি। তাদের বিপিএম-৬ পদ্ধতি মোতাবেক রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলার কম ছিল)। তাই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রিজার্ভকে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরানো।