কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা ফেরত আনবে কে
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারি দল নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
ক্ষমতাসীন দল কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। এবারের নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৪ জন ছাড়া ৫৮ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। ফলে ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল। যেটাকে তাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। তাই আবার ভোটের পর তারা বলেছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সরকারের অধীনে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে বহুল-প্রশংসিত হলেও, পরাজয় মেনে নেয়নি বিএনপি। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। যে ষড়যন্ত্রটি এ দেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগেই রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, সিভিল আমলাতন্ত্রের ডিসি, এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি, এসপি, ডিএসপি, এএসপি, ওসি—সবার নির্বাচনকালীন ভূমিকাকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহারের ফন্দি-ফিকিরগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তে চলে আসে। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে মার্চে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও পিছিয়ে দিয়েছিলেন। পত্র-পত্রিকায় কারণ উদ্ঘাটিত হলো, স্বাধীনচেতা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের চেয়ে তুলনামূলক নিরীহ প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে আওয়ামী লীগ অধিকতর নিরাপদ বিকল্প মনে করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই।
একই সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন আমলাও গোপনে তাঁদের হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছিলেন সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে ছক আওয়ামী লীগ সাজিয়ে রেখেছিল, তা কীভাবে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের গণ-ট্রান্সফারের মাধ্যমে তছনছ করে দেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুইদ-মইনুল-শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে ওই বিএনপি-জামায়াতপন্থী কুশীলবেরা দুই মাসের কম সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন কর্মকর্তার ট্রান্সফার সুসম্পন্ন করার কাহিনি পরবর্তীকালে ওই কুশীলবদের কয়েকজনের পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত জবানিতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিএনপি দাবি তুলল, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। সারা দেশে, নয়তো আওয়ামী লীগের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ-সম্পর্কীয় সুপারিশ মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান-পাতি মাস্তান-ক্যাডারদের, পালিয়ে বাঁচল বীর-পুঙ্গবেরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল, এই সত্যটাও এত দিনে খোলাসা হয়ে গিয়েছিল।