‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আর নয়, এবার কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি চালু করুন
২০২৪ সালটি শুরু হলো নতুন সরকার দিয়ে। পরিচিত-অপরিচিত মুখ দিয়ে তা গঠিত। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। প্রথম প্রত্যাশাটাই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি রোধ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার তার কাজ শুরু করবে একে প্রাধান্য দিয়ে। যদিও বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজের মধ্যে রয়েছে আরও ১০টি কাজ। মোট ১১টি বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজের মধ্যে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার অঙ্গীকার এক নম্বরে। যদি তাই হয়, তাহলে অবশ্যকরণীয়ের মধ্যে পড়ে বেশ কয়েকটি কাজ। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাণিজ্যনীতির সমন্বয় ছাড়া দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা সম্ভব নয়। এটাও আজ পরিষ্কার-এ তিন নীতির সমন্বয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, আসছে না। গেল নভেম্বরেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এর মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এবং তা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের বাজার তা-ই বলে। কোনো জিনিসের দামই এই ভরা শীতকালেও কমেনি, বরং কোনো কোনোটির দাম বেড়েছে। যেমন অতিপ্রয়োজনীয় চালের দাম আমন মৌসুমেও একটুও কমেনি। বরং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খবর হচ্ছে, চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কারণ হিসাবে খবরের কাগজে চালের মিল মালিকদের দায়ী করা হচ্ছে, যা অতীতেও হয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চালকল মালিক এবং বড় বড় আড়তদার। দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, চালের বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ কাজ করছে।
শুধু চালের বাজার নয়, সব ভোগ্যপণ্য এবং অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী। এটা আমার কথা নয়, পূর্বতন মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ সবাই একবাক্যে বলেছেন, ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটা সিন্ডিকেট। চাল, গম, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আটা-ময়দা, ডিম, দুধ, গোল আলু থেকে শুরু করে সব পণ্যের বাজারে কাজ করছে সিন্ডিকেট। খবরের কাগজের রিপোর্ট, অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য ইত্যাদিও প্রমাণ করে-সিন্ডিকেট আমাদের জ্বালিয়ে মারছে। একজন সাবেক মন্ত্রী তো বলেইছিলেন যে, সিন্ডিকেট দমন করা সম্ভব নয়। এরা খুবই শক্তিশালী। এদের গায়ে হাত দিলে বাজার তছনছ করে দেবে তারা। দৃশ্যত বোঝাও যাচ্ছে তা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজেদের অর্থ লগ্নি করেছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়। রয়েছে ব্যাংকের উদার ফিন্যান্স। তারা এত বড় যে নিজেদের জাহাজেই তারা পণ্য আমদানি করে। অথচ স্বাধীনতার পর ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ‘গ্রুপ এলসি’ করে আমদানি করত। টাকা ছিল না। আজ আর এ অবস্থা নেই। বড় বড় ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী আমদানি করে। পণ্য প্রসেস করে, স্টোর করে, পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এ অবস্থায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেটের কাছে বিগত সরকার ছিল অসহায়। তাহলে নতুন সরকার কী করবে?
নতুন সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। যেহেতু এ সরকার চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে, দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে। অথচ সিন্ডিকেট যতদিন সক্রিয় থাকবে, তাদের দাপট যতদিন অব্যাহত থাকবে, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যতদিন নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে-ততদিন জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব নয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, ডাল, তেলের দাম কমতির দিকে। সিন্ডিকেটের কারণে আমরা এর সুবিধা পাচ্ছি না। উলটো এখন আবার নতুন আশঙ্কায় আছি আমরা। সামনে পবিত্র রমজান মাস। রমজান উপলক্ষ্যে সিন্ডিকেট, আড়তদার, এমনকি ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরাও বছরের ব্যবসা করে এক মাসের মধ্যে। তেমনি বাজেটের সময়, ঝড়-বৃষ্টি-তুফান-খরা ইত্যাদির সময়েও তারা তা করে। তারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার সুবিধা হয়েছে-তারা এখন নির্বাচনি রাজনীতিতেও ঢুকছেন। রাজনীতি, দল, প্রশাসন, ব্যবসা, ব্যাংক-বিমা সব এখন তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট এগিয়ে গেছেন।