‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে...’
আমাদের গ্রাম এলাকার মানুষ প্রায়ই একটা কথা বলে-‘শিখেছিলে কোথা থেকে? ঠেকেছিলাম যেখানে’। শুধু আউলিয়া-দরবেশরাই ঠেকে শেখে না, চোর-ডাকাত, মহান রাজনীতিকরাও ঠেকে শেখে। এজন্যই মনে হয় এমন একটা প্রবাদ চালু আছে-‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’। সত্যিই কি ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়? আমি ভাবি, একবারই বেলতলায় গেলে চলে কীভাবে? হয়তো বারবারই বেলতলায় যায়, কিন্তু ভিন্নভাবে, সতর্কতার সঙ্গে। হতে পারে কখনো মাথায় পাগড়ি প্যাঁচিয়ে, কখনো মাথায় কম্বল জড়িয়ে, কিংবা আরও বহুরূপে। ভিন্নভাবে বেলতলায় না গেলে বেল কুড়াবে কীভাবে? এ দুর্দিনে ন্যাড়াকে নিয়ে এত চিন্তা না করাই ভালো; ন্যাড়া তার অভিনব চিন্তা ও পদ্ধতি নিজের প্রয়োজনে নিজেই আবিষ্কার করে ফেলবে।
আমি ভাবছি এদেশের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একটা আপেক্ষিক কথা। একজনের দৃষ্টিতে যেটা অংশগ্রহণমূলক, অন্যের দৃষ্টিতে সেটা অংশগ্রহণমূলক নাও হতে পারে। বিষয়টা নিয়েও মহান রাজনীতিকদের তর্ক সামনে আসছে। ধৈর্য ধরে আমরা ‘রুপালি পর্দায়’ দেখার অপেক্ষায় থাকি। সমস্যাটা আদৌ এরকম নয়। এদেশের নব্বই শতাংশ মানুষই মুসলমান। শুনেছি, ‘মুসলমানের এক জবান’। সেটাই এদেশের কাল হতে চলেছে। কেউ বলছে, ‘বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। আমরা সংবিধানের অতন্দ্র প্রহরী।’ অন্যপক্ষ বলছে, ‘আমরা তো তোমাদের পরপর দুবার দেখলাম, তোমাদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তোমাদের কূটকৌশলের অভাব নেই। ভোট ব্যবস্থাপনায় তৃতীয় দু-চোখওয়ালা পক্ষকে আনো। নইলে যাব না, যাবই না।’ বুঝলাম, মুসলমানরা জবানের মূল্য বেশি দিচ্ছে। কিন্তু কার প্রতিজ্ঞার যৌক্তিকতা বেশি, এটা নিয়েও তো ভাবা যেতে পারে। গত ৩১ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘হয়তো এ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে...সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের অধিকারের যে নির্বাচন, সেটি নিশ্চিত করা যাবে না। এ নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা বা ভোটের আস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে।’ আমার মনে হয়, বিপরীতমুখী দুটি জোট যেহেতু প্রতিজ্ঞা ভাঙবে না, এ বিষয়ে প্রয়োজনে যারা এদেশের মালিক (জনগণ) বলে বলা হয়, তাদের কাছে যাওয়া যেত। ইচ্ছা হলে গণভোটের ব্যবস্থা করা যেত। ইচ্ছা যদি থাকে সমস্যা সমাধানের, তবে অনেক পথ খোলা থাকে। প্রয়োজন অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা এবং আত্ম-অহংবোধ একটু কমানো।
এখন এ ভোটে যাওয়া-না-যাওয়ার পালা আপাতদৃষ্টিতে শেষ বলে মনে হচ্ছে। এখন ‘জোর যার মুল্লুক তার’ পর্যায়ে চলে গেছে। কেউ যেভাবেই হোক নির্বাচন করবেই। কেউবা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেবেই। উভয়ে যার যার অবস্থানে বদ্ধপরিকর। কার কী মনের উদ্দেশ্য, আমরা সাধারণ দু-চোখওয়ালা মানুষ কিন্তু বুঝি। আমরা দলবিচ্ছিন্ন বলে আমাদের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় না। আমরা (দেশের নাগরিক হিসাবে) এদেশের মালিক-একথা কেউ মানেও না; মানলেও মুখে মানে, অন্তরে অস্বীকার করে। দীর্ঘ বছর ধরে দেখতে দেখতে এসব ‘এক-জবানি’ মুসলমানদের কথার ওপর আমিও আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। এরা বারবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। ’৯১ সালে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক জোট একটি গণতন্ত্র-উত্তরণের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল। এরা এ রূপরেখায় স্বাক্ষর করে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ, সার্বভৌম সংসদ গঠন, জবাবদিহিমূলক নির্বাহী বিভাগ প্রতিষ্ঠা, জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকার করেছিল। আমার প্রশ্ন, সেসব অঙ্গীকারের কী দশা হলো? ‘কেউ কথা রাখেনি।’ জোটবদ্ধ স্বার্থবাদী মনের আকাশ অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার চাঁদের সবটুকু আলো ক্রমেই ঢেকে দিয়েছে। জাতিগতভাবে বাঙালি খুব আত্মবিস্মৃত। আত্মজিজ্ঞাসা এদের খুব কম। কূটবুদ্ধি ও কূটকৌশলে বাঙালি চমৎকার! ভাবতে ভীষণ অবাক লাগে! ইতিহাস তাই-ই বলে।