খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর কোন পথে?
গত ২৪ থেকে ২৬ জুলাই ইতালির রোম শহরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর সদরদপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল খাদ্য ব্যবস্থা সম্মেলন +২। এফএওর সঙ্গে সহ-উদ্যোক্তা ছিল বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও ইফাদ। অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০টি দেশের রাষ্ট্র-সরকারপ্রধানসহ ১৬০টি দেশ থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি। বাংলাদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নিয়েছে। আমি আগ্রহভরে খবরগুলো পত্রপত্রিকায় পাঠের চেষ্টা করেছি, কিন্তু খুব বেশি তথ্য পাইনি। জাতিসংঘের এ ধরনের সভা আমাদের দেশের মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছে। এর সঙ্গে আমাদের সবার জীবন যুক্ত। অথচ সম্মেলনে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তার কোনো তথ্য জনগণ তো নয়ই; এমনকি যারা এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে চান তাদের কাছেও পৌঁছায় না। পত্রিকায় যে খবর আসে তা প্রধানমন্ত্রীর সফর সংক্রান্ত প্রতিবেদন হয়ে যায় এবং সেখানে ইতালিতে তাঁর রাজনৈতিক সভা, সংবর্ধনা ইত্যাদির খবরসহ থাকে। আরও দুঃখজনক, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগদানের আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো প্রকার মতবিনিময় করা হয় না। ফিরে এসেও কোনো প্রকার তথ্য দেওয়া হয় না। কিন্তু এই সম্মেলনে সরকারপক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে এবং সে সম্মেলনে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বিশ্বের খাদ্যের ভোক্তা মানুষ বিশেষ করে কৃষকদের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, সেটা নিয়ে দরকারি আলোচনা হওয়া উচিত।
বাসসের খবরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি বিভিন্ন সাইড ইভেন্টে তাদের অর্জনের কথা তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ৫ দফায় মূলত আধুনিক কৃষি এবং বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর করপোরেট কৃষির কথা বলা হয়েছে। কৃষকের অধিকারের কথা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের কারও কারও উপস্থাপনায় পাওয়া যায়। ইউটিউবে পাওয়া সাইড ইভেন্টে প্রদত্ত বক্তব্য শুনে এমন ধারণা করছি। এর বাইরে যদি বলা হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ধন্যবাদ দেব।
এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না, খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটছে এবং এর প্রয়োজনও রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থা সম্মেলন +২ মূলত দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত খাদ্য ব্যবস্থা শীর্ষক সম্মেলনে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর অগ্রগতি বা স্টকটেকিংয়ের জন্যই ছিল। তাই এর প্রেক্ষাপট একটু দেখলে বুঝতে পারব খাদ্য ব্যবস্থা রূপান্তরের জন্য সম্মেলনে কারা বেশি সক্রিয় ছিলেন এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নিজেই কাদের নির্দেশনায় কাজ করছে। এসব দেখা এই কারণেও দরকার, বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। একদিকে করপোরেট আধিপত্যের কৃষি, অন্যদিকে প্রাণবৈচিত্র্য ও কৃষকের অধিকারনির্ভর চাষাবাদ। গত ৫০ থেকে ৬০-এর দশকজুড়ে সবুজ বিপ্লব নামে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি তোলানির্ভর চাষাবাদ করে পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয়েরও অন্যতম কারণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি। বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে এ ধরনের কৃষির প্রবর্তন করা হয়েছিল বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে। এখন সেই কৃষি আর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। কৃষকরাও ক্রমবর্ধমান সার ও কীটনাশকের মূল্য, মাটির তলার পানির খরচ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বা চালের নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে দাবি করা হলেও অন্যান্য খাদ্য যেমন ডাল, তেল, সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। কীটনাশক প্রয়োগে বাধাগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় জাতের মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন। অর্থাৎ খাদ্যের অন্য সব উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।