অন্যদিনের অপেক্ষায়

www.ajkerpatrika.com বিধান রিবেরু প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫, ১৩:০৩

মানুষ যেদিন থেকে গল্পটা নিজের মতো করে বলতে শিখল, সেদিন থেকে সে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরল, আবার একে অপরের কাছেও এল। বাক্যটি স্ববিরোধী মনে হলেও এর ভেতর বিন্দু পরিমাণ বিরোধ নেই, বরং ঐকতান আছে। এই দূরত্ব ও নৈকট্যকে যে মানুষ পাখির নজরে পরখ করতে পারে, সেই মানুষ সেতারযন্ত্রে তোলা সুরের মতো ঐকতানের ধারায় ভাসতে পারে। সমাজে এই সুর ধরার ক্ষমতা অর্জন করতে পারাটাই আসল ব্যাপার।


কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ‘অন্যদিন...’ চলচ্চিত্রটি দেখে আমার মানব ইতিহাসের দ্বন্দ্ব ও ঐক্য, ভ্রান্তি ও ক্রান্তির কথাই মনে হয়েছে। এক পুরোনো স্টিমারে করে যাত্রা শুরু করে কয়েক শ যাত্রী। তাদের ভেতর অবলা প্রাণী থেকে শুরু করে চপলা কিশোরী, টগবগে তরুণ, ভিনদেশি পর্যটক, বিত্তবান গৃহিণী, দরিদ্র বৃদ্ধ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, ঝানু রাজনীতিবিদ, আগামীদিনের সাংবাদিক, অন্ধ ভিখারি গায়ক... কে নেই? এ যেন গোটা রাষ্ট্র ও নাগরিকের রূপক, সময়ের স্রোতে ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান। দেশ অথবা জীবনের অভিযাত্রার গল্প নির্মাতা আমাদের শোনান। সেই গল্পের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরও ছোট ছোট গল্প। মানুষের জীবনটাই তো তাই। গল্প বলার ইতিহাস। কারও গল্পে সৃষ্টিকর্তা প্রধান। কারও গল্পে সাইবার দুনিয়ায় থাকা লাখ লাখ ফ্যান-ফলোয়ারই সব। কেউ সেই গল্পে আস্থা রেখেছেন, যেখানে বলা হয়েছে মানবজাতির ইতিহাস, শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। তাই সে প্রশ্ন তোলে, একই ডেকে থেকে কেন তাকে নিচের তলায় প্রাকৃতিক কাজ সারতে হবে? যারা টাকা বেশি দিয়ে কেবিন নিয়েছে, তারা কি অধিক পুরীষ উৎপাদন করে?


শ্রেণির প্রশ্ন আরও উজ্জ্বল হয় খাবারের টেবিলে, যখন উচ্চবিত্ত ঘরের ভাবিরা ড্রাইভারদের মুরগির রান দেওয়া প্রসঙ্গে কথা বলে। কেউ নিজেকে দরদি প্রমাণ করার চেষ্টা করে, কেউ আবার বলে, সে স্বঘোষিত সংকীর্ণমনা। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার, ছোটলোকের সঙ্গে এক টেবিলে কেউ খায় নাকি? বড়জোর তাদের করুণা করা যায়। আর যারা ছোটলোক? অর্থাৎ সমাজে যাদের কণ্ঠস্বর নেই, সাব-অলটার্ন, তারা কী বলে? তারা জীবনে ঘটে যাওয়া বীভৎস দুর্ঘটনার পর পায়ে রড ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। লোকটি হতবিহ্বল। তার স্ত্রী অকূলপাথারে ভাসছে, আসছে দিন চলবে কী করে, তার দিশা খোঁজে। তারই শ্রেণিভুক্ত আরেক নারী পরামর্শ দেয়, স্বামীর জন্য মানুষের কাছে হাত পাতা যায়, এতে লজ্জার কী আছে!



ধনী ব্যস্ত মুরগির পা কে খায় তা নিয়ে, আর গরিব অস্থির তার পঙ্গু পা নিয়ে সে চলবে কেমন করে সেটা নিয়ে। মাঝে মধ্যবিত্ত ব্যস্ত শিল্পের কলাকৈবল্যবাদ নিয়ে বাদানুবাদে। একদল ছেলেমেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হবে, তাদের ভেতর একজন কবি, একজন গায়ক। খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মনোমালিন্য হয়। আবার নদীর এক ঢেউ যেমন আরেক ঢেউয়ের ওপর পড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তেমনই তাদের মেলামেশা। বোঝা মুশকিল, তারা কী নিয়ে তর্ক করে, কী নিয়ে সখ্য গড়ে, কী নিয়ে হয় উদ্বেলিত। তাই, তাদের মজমাতেই জমে ওঠে মহীনের ঘোড়াগুলির গান: ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি, খিদের থেকেও স্পষ্ট।


তবে আগেকার দিনে, যখন বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের অতটা প্রসার ঘটেনি, গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা হতো, তখন সেখানে থাকত বিবেক নামের এক চরিত্র। কামার আহমাদ সাইমনের এই ছবিতে বিবেক চরিত্রের মতোই নাজিল হয় এক অন্ধ ভিখারি, সোহেল তার নাম। সে অপূর্ব গলায় মারফতি ও মরমি গান গায়। গানে গানে বলে জীবন দর্শনের কথা: মানুষ আইবোরে, এক নজর দেখিতে মানুষ আইবোরে। এক ধার্মিক বৃদ্ধকেও বলতে শোনা যায় মানুষের জন্মের পর মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা। ভিখারি ও ধার্মিকের বক্তব্য একই, এখানে ঐকতান, কিন্তু জীবনের গল্পে তারা আলাদা সত্তা, তারা যে গল্পে ইমান রেখেছে, সেটাও স্বতন্ত্র বটে।


শ্রেণি ও আধ্যাত্মিকতার বাইরে আমরা দেখি রাজনীতির গল্প। রাজনীতিতে উন্নয়নের নামে লুটপাট ও গুমের গল্প। নির্মম সত্য ও জলজ্যান্ত মিথ্যার গল্প। গল্প বলার ছলে এক রাজনীতিবিদ সঙ্গীকে বলেন, রাজনীতিও ফুটবলের মতো একটি খেলা। এই খেলায় মন খারাপ করে বসে পড়লে চলে না। আশা জিইয়ে রাখতে হয়। এরই ফাঁকে আমরা স্টিমারের লোকজনকে পানির গভীরতা মাপতে শুনি: দুই বাম মিলে না, দুই বাম মিলে না। তখন এক ঝটকায় মনে পড়ে দুটি বিষয়। মনে পড়ে, বাংলাদেশে এত অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতরেও দুই বামপন্থী নেতা কখনো এক হয় না। তারা শুধু ভেঙে টুকরা টুকরা হয়। আর ফায়দা লোটে অন্যরা। আর মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই ফটিকের মৃত্যুযন্ত্রণাকে। যে নদীপথে গ্রাম থেকে শহরে আসার সময় খালাসিদের মুখে শুনতে পেয়েছিল: এক বাঁও মেলে না, দুই বাঁও মেলে না। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় সে এই কথাগুলোই বকতে থাকে। অর্থাৎ গ্রামের মুক্ত পরিবেশ থেকে শহরের যান্ত্রিক ও ঘিঞ্জি পরিবেশে এসে ফটিক যেমন কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিল না, তার প্রাণ মুক্তির জন্য আইঢাই করছিল, তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতর থাকা মানুষও যেন পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। দেশ এখন ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বেরিয়ে জনতার নৈরাজ্যবাদে এসে ঠেকেছে। মুক্তি কোথায়? আশা-দূরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে স্টিমারের মতোই আমরা কখনো হারিয়ে যাচ্ছি ঘন কুয়াশার ভেতর।


আবার কুয়াশা সরে যাওয়ার পর কোনো তীরে যদি নোঙর ফেলি, তো সেখানে বিপাকে পড়ছে স্টিমারের চাকা। নিদান হয়তো মেলে এসব বাধাবিপত্তি থেকে, কিন্তু চিন্তা-দুশ্চিন্তার খেলা থামে না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও