মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচবে কেমন করে?
মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় থাকায় আবেগ-অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে আমাদের। মানবিক সম্পর্ক হালকা হতে হতে তলানিতে পৌঁছে গেছে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং ইউজিসির সাবেক সদস্য তারেক শামসুর রেহমানের কথা। এমন একজন সোচ্চার মানুষকে অবসর জীবনে একাকী একটি নির্জন ফ্ল্যাটে বসবাস করতে করতে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল নির্মমভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে দেখেছি আমরা। মৃত্যুকালে পরিবারের সদস্যদের পাশে পাননি তিনি। পরে খবর পেয়ে পুলিশ দরজা ভেঙে তাঁর লাশ উদ্ধার করে। জানা যায়, তাঁর পুরো পরিবার বিদেশ থাকে এবং তিনি একাই দেশে থাকতেন। একইভাবে একাকিত্বের কশাঘাতে ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মোহসিন খান। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে এক নারী ও তাঁর দুই যমজ মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহখানেক ধরে তাঁরা না খেয়ে ছিলেন এবং কেউ তাঁদের খোঁজ রাখেনি। ১৫ দিন বাসায় বাজার হয়নি। ছিল না বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও। তাঁদের ঘরে খাবার, পোশাক কিছুই ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। সংবাদমাধ্যমে আসার কারণে এই তিনটি ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। এর বাইরে যে হাজারো ঘটনা আছে তার খবর কেউ রাখি না। সময় কোথায়?
ওপরের তিনটি ঘটনা আমাদের সমাজের এক নির্মম চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মানুষে মানুষে দূরত্বের কারণেই এমনটা ঘটছে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব- সবাই এতটাই ব্যস্ত আর স্বার্থপর হয়ে উঠেছি যে কেউ কারও সেই অর্থে খোঁজ রাখছি না। ইট-পাথরের এই নির্মম শহরে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, দূরত্ব যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবণতা শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত প্রবীণদের মধ্যে বেশি। এ কারণে একদিকে যেমন বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা, তেমনি মানবজীবনের চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যুর সময় পাশে কাউকে পাচ্ছেন না অনেকেই। মাঝে মাঝে দেখি এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, যাঁর চারপাশ ঘিরে রাখত অসংখ্য মানুষ, তেমন প্রবীণটিকে শেষ জীবনে নিঃসঙ্গতা নিয়ে একা একটি নির্জন ফ্ল্যাটে বসবাস করতে। কখনও কখনও প্রবীণ স্বামী-স্ত্রীকে পাওয়া যায়। আবার কখনও কখনও শুধু স্বামী বা স্ত্রী। হয়তো স্ত্রী কিংবা স্বামী মারা গেছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে কিংবা দেশে থাকলেও যার যার আলাদা সংসার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে বাবা-মায়ের খোঁজ রাখার সময় নেই তাদের। কাজের প্রয়োজনে এমন অনেক প্রবীণের কাছে আমার মাঝে মাঝে যাওয়া হয় কিংবা ফোনে কথা বলতে হয়। তাঁদের কাছে গেলে কিংবা ফোনে কথা বললে ছাড়তে চান না সহজে। কারণ, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার মতো মানুষ নেই। এই না থাকাটা ঘোচাতে চান যখন যাঁকে পান তাঁর সঙ্গে কথা বলে।
আবার, ধরুন মফস্বলের এক পরিবারে কয়েক ভাই আছেন। এক ভাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কর্মসূত্রে রাজধানী কিংবা বিদেশে থাকেন, অন্য ভাইয়েরা কম শিক্ষিত হয়ে নিজ এলাকাতেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে খান এবং পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশোনা করেন। এই কম শিক্ষিত ভাইয়েরা এক সময় পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ আর কোনো অংশীদারকে দিতে চান না। শহরে থাকা ভাইটি যখন পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে আলাপ করতে যান তখন গ্রামের ভাইদের ভাবখানা এমন- এতদিন কোথায় ছিলি? অথচ বিভিন্ন সময়ে শহরে থাকা ভাইটির সাহায্য-সহযোগিতায় দিন দিন ফুলেফেঁপে উঠেছেন। সেই শহুরে ভাইকে গ্রামের ভাইয়েরা শিকড়ছাড়া করার পাঁয়তারা করে চলেন। শিক্ষাদীক্ষা ও আত্মসম্মানবোধের কারণে শহরে থাকা ভাইটি আর শিকড়ের দিকে যেতে পারেন না বা চান না। এ তো গেল একটি উদাহরণ। সম্পত্তি নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনের এমন বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা আছে, যা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা কঠিন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পরিবার
- যৌথ পরিবার