ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতিচর্চাহীনতা
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শাসক শ্রেণির ছাত্র সংগঠন পালাক্রমে আধিপত্য চালাচ্ছে। যখন যে সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসছে, তার ছাত্র সংগঠনের দখলে চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তারই অনাকাঙ্ক্ষিত ধারাবাহিকতায় গত প্রায় দেড় যুগ ধরে বর্তমান সরকার সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব করছে। এ দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে এরা একদিকে বিরোধী মতের ছাত্র সংগঠনগুলোকে শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করেছে, অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সুতরাং, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী শিক্ষার্থী নির্যাতনের যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তা হতাশাজনক হলেও বিস্ময়কর নয়।
পূর্বসূরিদের মতো বর্তমান সরকারও ছাত্র সমাজকে ভয় পায়। জনগণ সাধারণত সংগঠিত থাকে না। কিন্তু একসঙ্গে থাকার কারণে যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত হতে সময় লাগে না। তারা হলো সমাজের অগ্রসর অংশ; লেখাপড়া করবে, মেধা বিকশিত করবে। একই সঙ্গে নানা আন্দোলনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও তৈরি করবে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার বিষয়ে উদ্বিগ্ন সরকার ছাত্রদের এমন ভূমিকায় দেখতে চায় না। তারা চায় ছাত্র সমাজ যেন কখনোই আন্দোলনমুখী না হয়; বরং সরকারের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে। এ জন্য ছাত্রদের ভোগবাদিতার পথে পরিচালিত করতে যা যা দরকার তা সরকার সরবরাহ করে।
১৯৯১ সালে দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পুনর্যাত্রা করলেও তখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ আছে। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শুধু যোগ্য, জনপ্রিয় ও মেধাবী নেতৃত্বই বেরিয়ে আসে না; একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাও কার্যকর হয়। এই জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা যে আমাদের সরকারগুলোর পছন্দ নয়; তা জাতীয় সংসদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার তিন দশক পরও আমাদের সংসদ প্রায় একদলীয় ও অকার্যকর। রাষ্ট্রের কেন্দ্রে জবাবদিহি থাকলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ত। অতএব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবাবদিহির অনুপস্থিতিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না।
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে; হলগুলোতে তারা একসঙ্গে অবস্থান করে। এ শিক্ষার্থীদের কিন্তু বহুদিন ধরে কোনো সাংস্কৃতিক জীবন নেই। নির্বাচনও কিন্তু এক ধরনের সংস্কৃতিচর্চা, যা আগেই বলা হয়েছে- সেখানে নেই। সংগীত-কবিতা-আবৃত্তিচর্চা, লেখা, ম্যাগাজিন বের করা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সেখানে হয় না বললেই চলে। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বলি বা উচ্চ শিক্ষপ্রতিষ্ঠান; সেগুলো এক ধরনের সংস্কৃতিচর্চাবিহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু কোনো যান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নয়। সেখানে জীবন্ত তরুণরা আছে। তাদের সাংস্কৃতিক জীবন, মেধার স্বীকৃতি ও সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা দরকার। এসবের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে রাজনীতি, সংস্কৃতি বা খোলাধুলার ক্ষেত্রে তারা গড়ে উঠবে। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে না। এগুলো থাকলে ওই তরুণরা সুস্থ বিনোদনও পেত। সেখানকার তরুণদের কাছে এখন বিনোদন হলো ভিন্নমতের, এমনকি সহপাঠীদের ওপর নির্যাতন চালানো। ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অপরাধমূলক ক্ষমতা প্রদর্শনও কিন্তু এক ধরনের বিনোদন দেয় তাদের।