রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা
ঐতিহাসিক কালব্যাপী সর্বত্রই দেখা যায় মানুষের জীবনের সঙ্গে তার ভাষার কিংবা নিজের ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভাষা ছাড়া জীবনযাপন চলে না। মানুষের আত্মবিকাশের একপর্যায়ে তার জীবনের বিমূর্ত অঙ্গরূপে দেখা দিয়েছে ভাষা। সৃষ্টির ধারায় জীবন আগে না ভাষা আগে—এ প্রশ্নে অবশ্যই জীবনকে আগে পাওয়া যায়।
মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত করার এবং ভাষাকে বিকশিত করার সামর্থ্য মানুষের আছে। ইতিহাসজুড়ে মানুষকে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে-ওঠা প্রাণী। এই হয়ে-ওঠার বা উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান। পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার, সেই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের এই হয়ে ওঠার বা উন্নতির মূলে আছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি এবং শ্রমশক্তি। চিন্তাই ভাষা, ভাষাই চিন্তা। চিন্তা ছাড়া ভাষা হয় না, ভাষা ছাড়া চিন্তা হয় না।
দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত, ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত, জীবনও সেখানে উন্নত। ভাষার উন্নতি সাধিত হয় ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির এবং জাতীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি উন্নতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি ভাষায় নিপুণ, সমাজে তার সাফল্য ও মর্যাদা বেশি।
আরও দেখা যায়, ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। চিন্তা আগে না ভাষা আগে—এ নিয়ে বিতর্ক আছে ভাষা-তাত্ত্বিকদের মধ্যে। আমার ধারণা, এই বিতর্ক অমীমাংসেয়; কারণ চিন্তা ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য, একটিকে আগে অন্যটিকে পরে বলার উপায় নেই। মানুষের সব কর্মকাণ্ডেরই মর্মে কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। কাজের বেলায় শ্রমশক্তি পরিচালিত হয় চিন্তাশক্তি দ্বারা। চিন্তা ও ভাষা অভিন্ন, অবিভাজ্য।
জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর স্বাধীন আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল, ভাষাও বিকাশশীল। উন্নত জাতিগুলো তাদের ভাষার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা তৎপর থাকে নিজেদের ভাষার উন্নতি সাধনে এবং দুর্বল জাতিগুলোকে ভাষার দিক দিয়েও নির্ভরশীল রাখতে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাষ্ট্রভাষা