কী হওয়া উচিত অর্থনীতির ভিত্তি: ঋণ নাকি সঞ্চয়?
অস্ট্রিয়ান ধারার অর্থনীতিবিদদের মতে, পৃথিবীকে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে আসার মূল কারণ, ফিয়াট মানির মতো একটি জঘন্য মুদ্রা এবং একটি চরিত্রহীন অর্থব্যবস্থা যা সঞ্চয় নয়, ঋণকে অর্থনীতির ভিত্তি বলে মনে করে।
এক। প্রবল ও দুর্বল ভোগ-বাসনা
‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক। দূরের বাদ্য শুনে কী লাভ, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ ধরা যাক, রাম একটা গরু বিক্রি করল রহিমের কাছে। ওমর খৈয়ামের উপরোক্ত রুবাই বিশ্বাস করে, গরু বিক্রির টাকা দিয়ে রাম সেদিনই দামি কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে কিংবা কিনতে পারে দামি কোনো পোশাক অথবা টাকাটা সে স্রেফ উড়িয়ে দিতে পারে নেশা বা জুয়ায়। রাম যদি এটা করে, তবে বলতে হবে, রামের ‘ভোগবাসনা’ প্রবল, কিংবা ইংরেজিতে বললে, রামের ‘টাইম প্রেফারেন্স’ অতি উচ্চ।
পক্ষান্তরে রাম যদি গরু বিক্রির টাকা দিয়ে একাধিক বাছুর কিনে পালন করে কিংবা মাছ ধরার একটা জাল কেনে কিংবা একটা রিকশা কিনে চালায় বা ভাড়া দেয়, তবে বলতে হবে, রামের ভোগবাসনা নিয়ন্ত্রিত, টাকাটা সে এখনই ভোগ করতে চায় না। রাম বিলম্বিত ভোগে আগ্রহী। আপাতত বিনিয়োগ করে টাকাটা সে পরিমাণে বৃদ্ধি করতে চায়, যাতে নিজের এবং উত্তর পুরুষের জীবনে ভবিষ্যতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য আসে। যদিও এটা ঠিক যে খেয়ে-পরে বাঁচতে হয় সবাইকে এবং ভোগবাসনা কখনই শূন্যের কোঠায় নেমে আসে না, তবুও আমরা বলব, সভ্যতা নির্মিত হয়েছে সেই ব্যক্তিদের হাতে, ভোগবাসনা যাদের মনে অতি তীব্র নয়, যারা আগামীকালের কথা ভেবেছে, কায়মনোবাক্যে যারা চেয়েছে (ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে ঈশ্বরী পাটনীর মতো চেয়েছে): ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে!’
একবার বিমানে করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের সময় এক ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষিকার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। ওনার পিতামহের আমলেও ইংল্যান্ডে আজকের যুগের মতো খরচের নয়, সঞ্চয়ের সংস্কৃতি চালু ছিল। ‘নো পাউন্ড শ্যুড গো আউট অব দ্য হাউজ!’ অর্থাৎ ‘একটি পাউন্ডও বাড়ির বাইরে যাবে না!’ এই ছিল পরিবারের ‘অর্থ (ব্যয় সংক্রান্ত) নীতি’। সবজি লাগবে, জমি পড়ে আছে বাড়ির পাশে, চাষ করো গিয়ে! মাংস লাগবে, বন্দুক নিয়ে বনে গিয়ে দুই-চারটা খরগোশ মেরে নিয়ে আসো! ‘মাটন’ শব্দটাই নাকি ওনার দাদু চিনতেন না, কারণ আশৈশব বাড়িতে পালন করা ভেড়া বা র্যাম দেখে, খেয়ে তিনি অভ্যস্ত। এইভাবে সঞ্চয়ের সুকঠিন অভ্যাসের ভেতর দিয়ে কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডের জাতীয় মূলধন, যা দিয়ে হয়েছিল শিল্পবিপ্লব, গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বহু যৌথমূলধন ব্যবসায়, যার শেয়ারহোল্ডারদের খুশি করতে গিয়ে ষড়যন্ত্র করে পলাশীর যুদ্ধজয় করেছিল রবার্ট ক্লাইভ।
কাম্যতার ক্রমহ্রাসবিধির মতো দ্রুত ও বিলম্বিত লয়ের ভোগবাসনা ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা মাইক্রো ইকনোমিকসের সিলেবাসে পাবেন। কিন্তু এর প্ররোক্ষ প্রভাব পড়ে সামষ্টিক অর্থনীতি বা ম্যাক্রো ইকনোমিকসের ওপর। অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের মতে, যে সমাজের মানুষ ভোগবাসনা বিলম্বিত করে সঞ্চয় করে, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনটা সহজ করে রেখে যেতে পারে, যার ফলে সমাজ দিন দিন ধনী ও উন্নত হয়। মানুষের হাতে যখন পয়সা থাকে, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন– সব ক্ষেত্রে সমাজ এগিয়ে যায়। এর উদাহরণ ইতিহাসে আমরা একাধিকবার দেখেছি, রোমে এক নম্বর স্বর্ণমুদ্রার যুগে, মধ্যযুগের আরব দেশে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে উত্তম স্বর্ণমুদ্রা শাহাদা যখন চলমান ছিল বাজারে, ফ্লোরিন বা ডুকাট যখন ছিল ইতালিতে এবং সবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের চার দশকে। আমরা এটাও দেখেছি, যখনই মুদ্রার মান নিয়ে দুই নম্বরী হয়েছে, মূল্যের আধার কিংবা সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে মুদ্রা তার দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করতে পারেনি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ঋণ
- ভিত্তি
- সঞ্চয়
- বাংলাদেশের অর্থনীতি