গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপ বহুমুখী, পরস্পরবিরোধী ও একক লক্ষ্যগামী নয়
বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় অনেক কিছু ঘটছে। আগের একটি কলামে আমি একে গ্রামীণ বাংলাদেশের রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপ নামে আখ্যা দিয়েছিলাম, যা ঘটেছে ২০০০-২০২০ সালের মধ্যে। এর আগে গ্রামীণ রূপান্তরের প্রথম ধাপ ঘটেছিল স্বাধীনতার পরের তিন দশকে। গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পেতে চাইলে ও এর জটিল প্রকৃতি বুঝতে চাইলে আমাদের প্রয়োজন নতুন ধরনের গবেষণা পদ্ধতি। এ বিষয়ে আমি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ভেতর দিয়ে আমার সাম্প্রতিক সড়কপথের সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।
সনাতনী দ্বৈত ধারণার অসাড়তা
মাগুরার অন্তর্গত শিবরামপুর গ্রামে শওকত নামের একজন কৃষক আমাকে ড্রাগন ফল চাষের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করছিলেন। ড্রাগন ফল একটি ভীনদেশী ফল, যার উত্পত্তি মধ্য আমেরিকায়। ২০১৩-১৪ সালের দিকে বাংলাদেশে প্রথম এটির চাষ শুরু হয়। এ ফলটি জন্মায় লতানো ফণীমনসাজাতীয় গাছে, যা ধীরে ধীরে নিজের শেকড় বিস্তৃত করে এবং আগেই স্থাপন করে রাখা কংক্রিটের পোস্ট বেয়ে উঠতে থাকে। কংক্রিটের পোস্টটির ওপরের অংশে একটি টায়ার বসানো হয়, যার মাঝখানের অংশে দিয়ে গাছের সবুজ শাখা-প্রশাখা বাইরে বের হয়ে এসে চতুর্পাশে ঝুলে থাকে।
রেমিট্যান্স প্রভাবের উন্নতি
গ্রামীণ জীবনে রেমিট্যান্সের পরিবর্তনশীল ভূমিকা বিবেচনা করুন। আমি যশোর-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের মানুষের কাছ থেকে রেমিট্যান্স অর্থনীতি এবং তাদের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে মতামত শুনেছি, আমার মনে হয়েছে যে রেমিট্যান্স গবেষণায় আরো উন্নত এবং সূক্ষ্ম অনুসন্ধানের প্রয়োজন। মানুষজন আমাকে বলেছে, কীভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সামষ্টিক চেতনা একটি গ্রাম বা গ্রামপুঞ্জের তরুণদের একই গন্তব্যে যেতে প্রভাবিত করেছে। সে গন্তব্য জেদ্দা, মাস্কট বা রোম যাই হোক না কেন!
গ্রামীণ জীবনে মোবাইল প্রযুক্তির প্রভাব
মোবাইল প্রযুক্তি গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপের একটি বাস্তবতা। বাংলাদেশের সেলফোন বাজারের তথ্য-উপাত্ত এ দাবিকে সমর্থন করে। ১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোন, একটেল এবং সেবা টেলিকম চালু করা হয়েছিল। ২০০২ সালে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটক ২০১২ সালে দেশের প্রথম থ্রিজি নেটওয়ার্ক চালু করে এবং পরের বছরই এক কোটি সংযোগের লক্ষ্য পূরণ করে। ২০১৭ সালে সেলফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে, তার পরের বছর চালু করা হয় ফোরজি পরিসেবা। এখন দেশের গ্রামাঞ্চলে সেলফোন ছাড়া একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় একবার গেলেই যে কেউ একমত হবেন যে সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে, যদিও সব অঞ্চলে তা একই রকম নয়। শহুরে মধ্যবিত্তের মতোই গ্রামীণ মধ্যবিত্তের মাঝে ইলেকট্রনিকস (যেমন টেলিভিশন) এবং অ্যাপ্লায়েন্সের (যেমন ফ্রিজ) চাহিদা রয়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত নগর মধ্যবিত্তের মতো সম্পদ প্রদর্শন করার একটি গোপন ইচ্ছা পোষণ করে। গ্রামে গেলে প্রায়ই দেখা যায়, সবুজ এবং বিস্তীর্ণ ধানখেতের বুক চিরে উঠছে কৌলিন্যপ্রত্যাশী রঙচঙা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, যা গ্রামীণ মধ্যবিত্তের উত্থানের একটি প্রকট চিত্র।