সামাজিক বন্ধন কি হালকা হয়ে যাচ্ছে?
দেশ সাম্প্রতিককালে বেশকিছু সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের সাক্ষী হয়েছে, যা কোনো বিচ্ছিন্ন কারণে ঘটেছে বলে ভাবার কারণ নেই। এ ধরনের ঘটনার সংঘটন ধারাবাহিক, দৃশ্যত পরিকল্পিত ও কার্যত প্রতিকারহীন। ফলে বিভিন্ন শ্রেণির দুর্বৃত্তরাও এ নৈরাজ্যের ফায়দা নিতে মরিয়া। বিচারহীনতা এদের বড় প্রশ্রয়, বেপরোয়া শক্তির উৎস। এরা এক ধরনের সামাজিক অনুমোদনও পেয়ে যাচ্ছে। অজুহাতের অভাব হচ্ছে না। একদম না পেলেই বা কি এসে যায়? সাম্প্রদায়িকতার চেহারা পাকিস্তান আমলেও এমন ভয়ংকর ছিল না বলে অনেকে মনে করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গণপ্রতিরোধ দেখা গেছে, যা এখন বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অনেক দ্বিধা-সংকোচ চোখে পড়ছে। প্রোঅ্যাকটিভ পদক্ষেপের অভাব বিভ্রান্তির জায়গা চওড়া করছে। এমনকি এসব ঘটনার নিন্দা প্রকাশেও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর অহেতুক বিলম্ব সমাজের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট কৌশলী মনে হয়। সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক মাইলেজ নেওয়াতেই আগ্রহ বেশি থাকে। গণমাধ্যমের বড় একটি অংশকেও সতর্ক ও সংযতভাবে খবর প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সুশীলসমাজ, বিদ্বজ্জন, এমনকি প্রশাসনিক স্তর থেকেও তেমন কোনো সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা সমাজে আস্থা ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ এ জাতির জন্য এই বিচ্যুতি কতটা মানানসই, তা অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে জন্ম নেওয়া জাতিরাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়ার সংগঠিত অপ্রচেষ্টার বিপরীতে কার্যকর প্রতিরোধ কেন গড়ে উঠছে না, তা আলোচনা করা জরুরি।
জাতীয় সংসদে চেনামুখ একজন নারী সদস্য সেদিন সামাজিক বিভাজনের বিস্তার প্রসঙ্গে অকপটে স্বীকার করলেন-তার শৈশবের সঙ্গে তিনি বর্তমান সময়কে কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। তার মা-খালা-নানিকে তিনি যে বাঙালি আটপৌরে পোশাকে দেখেছেন, তা আজকাল বড় একটা দেখা যায় না। যেভাবে তারা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মবোধ অন্তরে লালন করেছেন, তাও সত্যি বলতে কী, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবিশ্বাস্য। নড়াইলের সেলিব্রেটি সংসদ-সদস্য হিংসা প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন সত্যি; কিন্তু তার অভিজ্ঞতাটাও মসৃণ ছিল না। রাজনৈতিক দল, সমাজ বা প্রশাসন-সবখানেই একটা অপ্রকাশ্য পিছুটান ছিল। উসকানি ছড়ায় এমন ধর্মীয় বা সামাজিক প্রচার সংযত করা যায়নি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষকরা বিজ্ঞান, সভ্যতা, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আলোচনা করার সাহস হারাচ্ছেন। এমন অবস্থা দেশকে পেছনের দিকে ধাবিত করার ইঙ্গিত দেয়, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। যে মুহূর্তে মহাবিশ্বের অচেনা জগৎ শিক্ষার্থীর সামনে নতুন করে উন্মুক্ত হচ্ছে, এদেশের ছেলেমেয়েরাও নাসায় এসব ইতিহাস লেখা গবেষণায় কাজ করছে, ঠিক সে সময় এদেশেরই শিক্ষার্থীকে পশ্চাৎপদ সংস্কারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার ষড়যন্ত্রের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে-কার স্বার্থে তা করা হচ্ছে বলা মুশকিল। দেশের সামর্থ্য বেড়েছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নও বিস্ময়কর। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-কত কী? দারিদ্র্য কমেছে ঠিকই, কিন্তু মনের দারিদ্র্য না ঘুচলে উন্নয়ন তো টেকসই হয় না। আর এ অবস্থার জন্য সমাজের দায় কতখানি তা বিশ্লেষণ করা দরকার।
অনেকেই ভেবেছিলেন-ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি হয়তো একাত্তরেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষাই ছিল সমতাভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠন। সত্তর-পূর্ববর্তী সামাজিক চরিত্র কি ১৯৭২ সাল থেকেই বদলে যেতে শুরু করেছিল-তাও সময়ের ইতিহাস অন্বেষী এক জিজ্ঞাসা। অনেকে মনে করেন, রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের প্রভাব ’৭২ থেকেই শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর নেতৃত্ব যথেষ্ট কার্যকর ন্যারেটিভ, মূল্যবোধ কিংবা শিক্ষায় সমাজকে প্রস্তুত করার সুযোগ বা সময় হয়তো পাননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাময়িক যে অভাব ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, তাকে পুঁজি করে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা পাক এজেন্টরা সমাজমনকে বিষিয়ে তুলতে পেরেছিল। এ অবস্থার জন্য ভারতকে, বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে তারা সফলভাবে দায়ী করতে পেরেছিল।