বাজেটের কচকচানি ও আমজনতার পেরেশানি
প্রথমেই মন্ত্রী বাহাদুরকে ধন্যবাদ জানাই এই কঠিন সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা শোনানোর জন্য। বিশ্বব্যাপী স্টাগফ্লেশনের এই মরা কটালে যেখানে উন্নত, অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে সবাই উন্নয়ন প্রাক্কলন নিচের দিকে নামিয়ে সংশোধন করতে ব্যস্ত, অর্থমন্ত্রী সেখানে অর্থনীতিতে কভিড-পূর্ব উন্নয়ন গতি ফিরিয়ে আনতে ব্রতী হয়েছেন; নয়া উদারনীতিবাদের আদর্শে অর্থনীতিতে পুনরুজ্জীবন দানে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি দেশীয় শিল্পের বিকাশে কর-ছাড় ও কর-প্রণোদনার প্রস্তাব করেছেন। তা ছাড়া তার প্রস্তাবিত সারসহ কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুকরণ, রপ্তানি বহুমুখীকরণে রপ্তানিমুখী শিল্পে কর হার সমন্বয়করণ, বিলাসপণ্যে শুল্ক বৃদ্ধীকরণ, ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি জমার ওপর শুল্ক আরোপ প্রভৃতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
কিন্তু এত বড় বাজেটে মুষ্টিমেয় কিছু ভালো প্রস্তাব থাকলেও আর যেসব প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলো অর্থনীতিতে কতটুকু প্রাণসঞ্চার করবে এবং করলেও তা কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, তা বলা মুশকিল। কিন্তু সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে যে, বাজেটের অনেক পদক্ষেপ ধনীদের যেমন বেশি সুবিধা দেবে, তেমনি অনেক কার্যক্রম সীমিত আয়ের মানুষজনের প্রকৃত আয় কমিয়ে ফেলবে। বর্তমানে অর্থনীতি যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বাজেট বক্তৃতায় তিনি সেগুলোকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছেন; অস্বীকারের রেওয়াজ ভেঙে সমস্যাগুলো স্বীকার করে নেওয়া অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু সেগুলো মোকাবিলা করার পথনির্দেশ তিনি উল্লেখ করেননি। ফলে বাজেট জনবান্ধবের পরিবর্তে এরই মধ্যে ব্যবসাবান্ধব হিসেবে তকমা পেয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের খুশি করার জন্য করপোরেট কর হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে; রাজস্ব খরার এ সময় এটা করা কি এতই জরুরি ছিল? টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে তা ফেরত আনতে যৎসামান্য কর (৭.৫ শতাংশ) আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু টাকা কেন পাচার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, দোষীদের কীভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায়, কীভাবে এটা কমানো যায়, তার কোনো কৌশল বা বিবরণ উল্লেখ করা হয়নি। মুদ্রাস্ফীতিতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে, কিন্তু করমুক্ত আয়সীমা আগের তিন লাখ টাকাই রেখে দেওয়া হয়েছে। যে ভারতীয় মুদ্রার মান এখনো টাকার চেয়ে বেশি, সেখানে করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ লাখ টাকা। এর অর্থ এ দেশে স্বল্প আয়ের মানুষের করভার বেশি এবং সামনে আরও সেটা বৃদ্ধি পেতে চলেছে। অথচ করমুক্ত ভাতার ঊর্ধ্বসীমা পাঁচ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ করা হয়েছে। ভাতার সুবিধা গ্রহণকারীরা প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত। ন্যায্যতার প্রশ্নে এই সীমা বরং কমিয়ে আনা জরুরি ছিল। মূসক ফাঁকির জরিমানা অর্ধেকে নামানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায়োগিক জটিলতা এড়ানো এবং বাধাহীন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কথা বলে এটা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফাঁকির শাস্তি বাড়ানোর পরিবর্তে কমানোর কী দরকার; এক্কেবারে মওকুফ করে দিলে ব্যবসা কি আরও গতিপ্রাপ্ত হবে না?