![](https://media.priyo.com/img/500x/https://samakal.com/uploads/2022/04/online/photos/Untitled-22-samakal-624c82ddc277f.gif)
টিপ নিয়ে হেনস্তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়
শনিবার তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার একজন পুলিশ সদস্যের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। প্রথমেই আক্রমণাত্মক গালি 'টিপ পরছোস ক্যান?' ড. সমাদ্দার ঘুরে দাঁড়ানোর পর তাকে আরও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে, তার পায়ের পাতার ওপর মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায় ওই শুশ্রূমণ্ডিত পুলিশ সদস্য। আজকাল মানুষ এত প্রতিবাদহীন যে, তাৎক্ষণিকভাবে কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে না। বাধ্য হয়ে ড. সমাদ্দার শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে একটি জিডি করেন। অবশ্য ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। রাজপথ থেকে এই প্রতিবাদ জাতীয় সংসদ পর্যন্ত গড়ায়। পরে ওই পুলিশ সদস্য চিহ্নিত হয় এবং তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।
প্রতিবাদের ভাষা এবং লেখালেখিতে মনে হয়েছিল, বিষয়টি তাৎক্ষণিক এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে পড়ে যায়, ষাটের দশকের মাঝামাঝি গণমাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী টিপ পরা নিষিদ্ধ করেছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পীরা টিপ পরেই গান গেয়েছিলেন, অনুষ্ঠান করেছিলেন। দেশের সব প্রগতিশীল শক্তি তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। যেমন দাঁড়িয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার সময়। পাকিস্তানের তদানীন্তন এক মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন রবীন্দ্র শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন। দেশের প্রগতিশীল বিচারপতি, অধ্যাপক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্র-জনতা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। পাকিস্তান জন্মের শুরু থেকেই বাঙালির ভাষা থেকে শুরু করে সর্বত্র আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম যখন তুঙ্গে তখন বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে এই ধরনের ঔদ্ধত্য অর্থহীন নয়, এর পেছনে গভীর এবং গুরুতর অর্থ আছে।
পঁচাত্তরের পর থেকে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি একটি তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। সেই অবস্থান থেকে তারা বাঙালির সঙ্গে মুসলিম শব্দকে যুক্ত করেছে। ফলে আলবদর, রাজাকার থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সব বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সেই ঐক্য প্রকাশ্যে ভেঙে গেলেও ঘাপটি মেরে সমাজের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছে। সারাদেশে তারা প্রথম আঘাত হানে নারী স্বাধীনতার ওপর। গ্রামেগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল এবং নানা ধরনের ইসলামী জলসার নাম করে যে জমায়েত হয়, সেখানে ধর্মভীরু নারীরা তাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু। গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকসংখ্যক নারী তাদের অর্জিত স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে বোরকা, হিজাব, পর্দা-আব্রু এসবের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে নেয়।
আজকাল গ্রামাঞ্চলে বোরকা-হিজাব ছাড়া কোনো নারীর চেহারা দেখা যায় না। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ষাটের দশকে কোনো বোরকা পরা ছাত্রী কল্পনাই করা যেত না, এখন সেখানে হাজার হাজার ছাত্রী বোরকা-হিজাব পরে ক্লাসে আসা-যাওয়া করে। হিজাব পরার কোনো কারণও সঠিকভাবে তারা ব্যাখ্যা করতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে কখনও মনে হয়, এ যেন নিছক ফ্যাশন মাত্র। এই যে হিজাব-বোরকার আগমন, এটা গত ত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে নারীদের নানাভাবে আক্রমণ করার ফসল। ওয়াজ মাহফিলের বক্তারা নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে নারীদের কাছ থেকে ওয়াদা নেয়। অসহায় ও পশ্চাৎপদ নারীরা জীবনের ভয়ে সেসব ওয়াদায় যুক্ত হয় যেত।
শনিবারের ঘটনা একটি ছোট্ট মহড়া।
এই মহড়াকে যদি কেউ তাৎক্ষণিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবেন, তাহলে গত ত্রিশ বছরে এভাবে গ্রাম ও শহরে নারীর পশ্চাদপসরণের ইতিহাসটাও ভাবতে হয়। যে কোনো পোশাক-আশাক পরার (শালীনতাবর্জিত নয়) অধিকার মানুষের আছে, বিশেষ করে সভ্য সমাজে সেই দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিবেচনায় রেখে। পঁচাত্তরের পরে আমরা দেখেছি এক দল পাকিস্তানি ভাবাপন্ন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোক কাবুলি পোশাক পরত। খোঁজ নিয়ে জানা যেত বাঙালি সংস্কৃতির ঘোরতর বিরোধী এরা। বাংলার সংস্কৃতিতে নানাভাবে আক্রমণ করার একটা ঐতিহ্য আমাদের দেশে শুরু হয়েছে। বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও এই শক্তি থেমে থাকে না। আর এর পেছনে অনবরত ইন্ধন জোগাচ্ছে একটি শক্তি যারা ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে থাকে। যেহেতু ধর্মকে ব্যবহার করাই সবচেয়ে নিরাপদ, তাই তারা যুগ যুগ ধরে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে ধর্মান্ধ করে তোলে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- টিপ
- ধর্মান্ধতা