কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নিশ্বাসটা বন্ধ হলেই আমার গল্প শেষ!

সারাক্ষণ জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ০৪ এপ্রিল ২০২১, ১১:৪৭

মন খুব খারাপ হলে আমি লিখতে পারি না। গলার কাছে এসে সব আটকে থাকে। বেঁচে থাকার আমার একটা কঠিন টেকনিক আছে। এই গ্রহের যাবতীয় বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে রেখে একটি সিন্দুকে নিজেকে আটকে রাখার একটি উপায় আছে। সেই সিন্দুকে একবার ঢুকে পড়লে এই গ্রহের কোনো কিছুই আর আমাকে ছুঁতে পারে না। এটা হলো একধরনের সারভাইভাল টেকনিক। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই টেকনিকও ব্যর্থ হয়।


প্রতিদিন যেভাবে কাছের মানুষগুলোর মৃত্যুর সংবাদ শুনছি, দিন শুরু হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে, আর শেষ হচ্ছে আইসিইউ দিয়ে; যার শেষ গল্প হলো মানুষটি আর নেই। এমন পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যেকোনো সেন্সেবল মানুষের জন্যই কষ্টের। প্রায় ১০ মাস ঘরের ভেতর বন্দী থেকে যেই মাত্র একটু বাইরে বের হতে শুরু করেছিলাম, তখনই আবার করোনা থাবা বসাতে শুরু করল। আবার ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। শুধু যে ঘরের ভেতর তা তো নয়! ঘরের ভেতর বসে দেখতে হচ্ছে- প্রাণ আছে আর নেই, এই খেলা!


এ বছরের প্রথম থেকেই বাংলাদেশে জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। আমি বাইরে গেলে মাস্ক পরতাম, ডাবল মাস্ক, সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে ফেসশিল্ড এবং মাথায় ক্যাপ, হাতে স্যানিটাইজারের বোতল। মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আমি নাকি বেশি বেশি করছি।


ফেব্রুয়ারি মাসে একটু সাহস করে বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেলাম নিজ বাড়ি ময়মনসিংহ, জিলা স্কুলের খেলা দেখতে। ব্রহ্মপুত্রকে দেখার লোভটাও সামলাতে পারছিলাম না। তাই রাজি হয়েছিলাম। বাসা থেকে বলা হলো, এই যাত্রা যদি আমি করোনাহীন ঢাকায় ফিরতে পারি, তাহলে বোঝা যাবে আমি সত্যি সত্যি স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে পারছি। খাওয়ার সময় আর নদের পাড় ছাড়া মাস্ক খুলিনি। তবে আশপাশের খুব কম মানুষকেই দেখেছিলাম মাস্ক ব্যবহার করতে। সবাই প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে বলেই মনে হয়েছিল। টিভিতে দেখেছি, উপজেলা শহরগুলোতে মানুষের মুখে মোটেও মাস্ক নেই। অর্থাৎ সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। তবু যতটা পারি সেই মাস্ক পরে ময়মনসিংহ ট্রিপ শেষ করে ঢাকায় ফিরে আইসোলেশনে থাকলাম। কয়েক দিন পর নিশ্চিত হলাম, না, ঝামেলা তেমন হয়নি।


কিন্তু মুহূর্তেই অবস্থা বাঁক নিয়ে ফেলল। পুরো উল্টো দিকে চলতে শুরু করল কোভিড। আর এখন তো বুকের ওপর চেপেই বসেছে। এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন এক বন্ধুর ম্যাসেজ- ‘এইমাত্র বাবাহারা হলাম আমি!’ এমন ম্যাসেজ চারপাশে সবাই পেতে শুরু করেছেন। কঠিন একসময়ের ভেতর আমরা আবার প্রবেশ করলাম।


২.


বাংলাদেশ একটি তরুণ দেশ। এ দেশের বেশিভাগ মানুষের বয়স ত্রিশের নিচে। বিশাল এই জনসংখ্যা এত দিন করোনার থাবার বাইরে ছিল। করোনা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই যখন এরা আবিষ্কার করল যে, তাদের তেমন কিছু হচ্ছে না, তখন আর তাদের ফেরায় কে? যৌবনের উচ্ছ্বাস তাদের জীবনের ধর্ম। চারপাশকে অবজ্ঞা করে তারা মাঠে নেমে পড়ল।


আমার বাসার ঠিক পাশেই একটি রেস্টুরেন্ট। আমরা যখন ঘরের দরজা বন্ধ করে মোটামুটি জেলখানায় আছি, তখন সেই রেস্টুরেন্টের আড্ডার শব্দে আমাদের ঘুমাতে সমস্যা হয়। বিকেল থেকেই উঠানে বসে বিশাল আড্ডা। আর সেই আড্ডা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। বুঝতে পারি, চারপাশে অন্যান্য রেস্টুরেন্টেরও একই অবস্থা।


ময়মনসিংহে গিয়েও দেখেছি একই অবস্থা। রেস্টুরেন্টে মানুষ গায়ে গায়ে বসে খাচ্ছে। খাওয়ার সময় তো আর মাস্ক পরার বালাই নেই। গাড়িতে কোথাও যাওয়ার সময়ও দেখি, মানুষ ছুটছে ঠিক আগের মতোই। পাশাপাশি পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও উপচে পড়া ভিড়। অর্থাৎ মানুষ ধরেই নিয়েছে, তার কিছু হবে না। এটুকু ঝুঁকি সে নিতেই পারে।


অন্যের উপকার হবে, এটা ভেবে আমি কিছু করব- এই চিন্তাটা বাঙালির ভেতর কম। বাঙালি হলো সেই জাতি, যেখানে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো কঠিন প্রবাদ চালু আছে। সেই সমাজে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মও অন্যের জন্য নিজের চাহিদাকে কমিয়ে দেবে, এটা হওয়ার কথা নয়।


আরো দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক। যেমন একজন ধনী মানুষ বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে দেবে এটা ভেবে যে, তাতে অন্য মানুষের বিদ্যুৎ পেতে সুবিধা হবে। এই ভাবনা বাঙালির ভেতর হবে না। আমার বাড়ির গেটের সামনের ময়লাটুকু পরিষ্কার করে রাখলে পুরো এলাকাটি দেখতে সুন্দর লাগবে- এমন ভাবনা বাঙালির আসবে না। সে নিজের ঘরটা পরিষ্কার করবে, গেটের বাইরেরটুকু করবে না। একইভাবে আমি মাস্ক পরলে অন্যের করোনা হবে না- এই ভাবনা বাঙালির হবে না।


বাঙালি খুবই স্বার্থপর জাতি। সে তার নিজের সরাসরি লাভ হবে তেমন কাজ করবে। সমষ্টিগত কোনো কাজে বাঙালিকে পাওয়া যাবে না। বন্যা কিংবা অন্যান্য সংকটের সময় দেখবেন, কিছু মানুষ কাজ করছে, বাকিরা জড়ো হয়েছে মজা দেখার জন্য। রাস্তায় আপনি মাটি খুঁড়তে থাকুন। দেখবেন অসংখ্য দর্শক পেয়ে গেছেন। আপনার সঙ্গে হাত লাগাবে, তেমন মানুষ খুব কম পাবেন। আপনি যেকোনো একটি কাজে হাত দিন। দেখবেন সমালোচকের অভাব নেই। বিরোধিতা সে করবেই। এই যে দেখুন, বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে এই বছর। আমরা সবাই কি এক হতে পারলাম? আঙুল আমরা সবাই সবার দিকে তুলতে পারব, কারণ আমরা তো কেউ ফেরেশতা নই। আমরা মানুষ। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে অনেক জাতি এক হয়ে যেতে পারে। আমরা পারি না। এখনো শিখিনি।


এই যখন বাঙালির চরিত্র, সেখানে অন্যের উপকারে নিজের আনন্দ কমিয়ে দেব, সেটা তো হওয়ার কথা নয়। আমি সেটা বাঙালির কাছে আশাও করছি না। নতুন প্রজন্মের কাছেও না। বাঙালিকে ওই জায়াগায় পৌঁছাতে আরো কয়েক হাজার বছর লাগতে পারে। কিংবা কখনোই হয়তো এটা হবেই না। এর জন্য যে মাইন্ডসেটের প্রয়োজন, সেটা এমনি এমনি হবে না। এর জন্য সর্বত্র যে অনুশীলনের প্রয়োজন হবে, সেটা আমরা আপাতত পেরে উঠব না। কারণ, আমরা এখন রেসের ঘোড়ার মতো ছুটছি। এখন আমাদের অনেক টাকার প্রয়োজন, সবাই ধনী হয়ে যাব- এটাই বর্তমান সময়ের ম্যাসেজ। মানবিক উন্নয়ন এখন অনেক ব্যাকডেটেড বিষয়।


কিন্তু করোনার মতো যেকোনো মহামারি প্রতিরোধে সামাজিক সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের শরীরে যদি করোনা ততটা না ছড়ায়, তাহলেই আমরা বেঁচে গেলাম। এর বাইরে বাঙালিকে ঠিক রাখা অসম্ভব।


৩.


বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আগের চেয়ে অনেক বেশি রেস্টলেস, অস্থির। তাদের বিশাল একটি অংশ কাউকেই বিশ্বাস করে না- কারণ সে নিজেকেই বিশ্বাস করে না। তার মাইন্ডসেট পেন্ডুলামের মতো- প্রতি মিনিটে এদিক সেদিক করে। যেহেতু সে প্রতিনিয়ত পেন্ডুলামের মতো জীবন যাপন করে, তাই পুরো পৃথিবীকে তার তেমনি মনে হয়।


তাকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকমের স্ট্রাগলের ভেতর দিয়ে চলতে হয়, সে জন্য সে আর কাউকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করার মতো বিষয়বস্তু তার চারপাশে নেই। ফলে এখন যে যা-ই বলুক, প্রথমেই সে ওটাকে সন্দেহের চোখে দেখে, অবিশ্বাসের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। ফলে আমরা এখন কোভিড নিয়ে যতই বলি, সে এগুলো বিশ্বাস করে না।


দেশে যখন কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল, তখন আমি এমন কথাও শুনেছি যে, সরকার ইচ্ছা করেই এমন তথ্য প্রকাশ করছে।


আমি জিজ্ঞেস করলাম, সরকার কেন এমন করবে?


উত্তর এল, দেখবেন মোদি আসবে না।


আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এর সঙ্গে মোদির সম্পর্ক কী?


হাসতে হাসতে উত্তর এল, কোভিডের ভয় দেখিয়ে তখন বলবে করোনার প্রকোপের জন্য মোদি তার সফর বাতিল করেছেন।


আমি অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নিজেকে একটা হদ্দ বোকা মানুষ মনে হলো। আমি আসলেই একটা বোকা মানুষ। নইলে এমন একটি সহজ জিনিস বুঝলাম না কেন!


একটি সমাজে সবাই তো আর ওপরের লোকটির মতো অতিচালাক হবে না, কিছু আমার মতো বোকা মানুষও থাকবে। যারা আমার মতো বোকা মানুষ, আমি শুধু তাদের জন্য একটা অনুরোধ করতে পারি। দয়া করে কি একটু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারেন, যেন অন্যরা আপনার দ্বারা আক্রান্ত না হয়? এটুকু কি করা যায় এই কঠিন সময়ে?


৪.


মৃত্যুর পর আমার নিজের কী হবে, সেটা নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। কারণ আমার যা-ই হোক না কেন, ওখান থেকে আমি এই পৃথিবীকে দেখতে পাব না। বিষয়টি এমন নয় যে, নিল আর্মস্ট্রংয়ের মতো চাঁদে গিয়ে পৃথিবীকে দেখলাম। মৃত্যুর পর আমি জানব না আমার প্রিয় শহরটি কেমন আছে, আমি জানব না আমার প্রিয় মানুষটি এখন কার সঙ্গে আছে, আমি জানব না আমার বাচ্চাগুলো এখন কোথায় কীভাবে আছে। তাই মৃত্যুর পর আমার নাম কেউ নেবে কি নেবে না, তা নিয়ে আমি ভাবি না। আমি বর্তমানকে বিশ্বাস করি। এখন যা ঘটছে, এটাই জীবন- এটুকুই আমি। এখন নিশ্বাসটা বন্ধ হলে আমার গল্প এখানেই শেষ!


যারা ওপরের কথাগুলোর গভীর অর্থ ধরতে পেরেছেন, তারা বিষয়টি বুঝে ফেলেছেন আশা করি। আমি যেহেতু এমন কঠিন জিনিসে বিশ্বাস করি, তাই আমার কোনো উচ্চাশা নেই, আমার কোনো অ্যাম্বিশন নেই, রাজনীতি করার আগ্রহ নেই, কোনো পদ-পদবি নেয়ার ইচ্ছা নেই, আমলা হওয়ার শখ নেই, ক্ষমতাশালী হওয়ার মোহ নেই, কে সালাম দিল আর দিল না, তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি একজন ‘নোবডি’ হিসেবে জীবন যাপন করতে চাই। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু বি নোবডি। আই ওয়ান্ট এ ভেরি সিম্পল লাইফ! তবে জীবনে অনেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাই। জীবনকে উল্টে-পাল্টে দেখতে চাই। আর যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন আমার দ্বারা যেন কোনো মানুষের ক্ষতি না হয়। এটা তখনই সম্ভব যখন আমি ‘নোবডি’ হতে পারব। এটা আপনি বিশ্বাস করেন আর না-ই করেন, তাতেও আমার কিছু আসে-যায় না।


আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে লিখি কেন?


আমি নিজের জন্য লিখি। লিখতে ভালো লাগে। আর যখন ভালো লাগে না, তখন লিখি না।


আপনি যদি একজন সেন্সেবল মানুষ হন, তাহলে আপনি আমার এই লেখাটার টোনটা ধরতে পারবেন এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে শুরু করবেন। আর যখন সেন্সেবল হবেন না, তখন নিজের প্রেমিকাকেও পতিতা মনে হবে। কারণ আপনার আপাদমস্তক সন্দেহে ডুবে আছে। তাই নয় কি? আপনার জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই!


এই বিপদের সময় বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ সুস্থ থাকুক।



ঢাকা, ২ এপ্রিল ২০২১
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
ই-মেইল: [email protected]

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও