ছবি সংগৃহীত

ওম পুরি: অভিনয়, বিতর্ক ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে অভিনেতার জীবন

শামীমা সীমা
সহ সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:০৪
আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:০৪

প্রয়াত অভিনেতা ওম পুরি। ছবি: সংগৃহীত

(প্রিয়.কম) শুক্রবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বলিউডের শক্তিমান অভিনেতা ওম পুরি। মুম্বাইয়ের নিজ বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৬৬ বছর বয়সী এই অভিনেতার। তার মৃত্যুতে শোকাহত গোটা বলিউড পরিবার। বলিউডের শীর্ষ তারকারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রয়াত এ অভিনেতার প্রতি।

নিজের মৃত্যু সম্পর্কে পুরি কথা বলেছিলেন ২০১৫ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। সে বছর মার্চ মাসে তিনি বলেছিলেন, ঘুমের মধ্যেই হয়তো মৃত্যু আসবে তার। ঘটনাচক্রে তার মৃত্যু অনেকটা সেভাবেই হয়েছে।

তার কথায়, ‘মৃত্যুটা তো বুঝতেই পারে না কেউ। ঘুমের মধ্যেই হয়তো চলে যাব। আপনারা হয়তো জানতে পারবেন সকাল সাতটা বাইশ মিনিটে ওম পুরি মারা গেছেন।’ কথাগুলো বলেই হেসে ফেলেছিলেন অভিনেতা। ওম পুরি আরও বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর ভয় নেই। অসুস্থ হয়ে পড়াটা আরও ভয়ের। যখন দেখি মানুষ অসুস্থ হয়ে গিয়ে চলাফেরা করতে পারে না, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে - আমার সেটাতেই বড় ভয়।’

শেষ অভিনয়ে ওম পুরি। ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র জগতে অবদানের জন্য 'পদ্মশ্রী' পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ওম পুরি। রুপালী পর্দায় তাকে দেখতে না পাওয়া চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য বিরাট ক্ষতি। তবে শেষবারের জন্য কোন কোন ছবিতে দেখা যাবে ওম পুরিকে, অনেক ভক্তেরই আগ্রহ রয়েছে তা নিয়ে।

ওম পুরির অভিনয় করা শেষ ছবিটি মুক্তি পাবে, কবির খান পরিচালিত ‘টিউবলাইট’। ছবিতে প্রধান চরিত্রে আছেন সালমান খান। এ বছরই রোজার ঈদে মুক্তি পাবে ছবিটি। তবে এখনও ‘টিউবলাইটে’র কিছু দৃশ্যে তার শুটিং বাকি ছিল। এর আগেই চির বিদায় নিলেন ওম পুরি। তাই বাকি অংশ কিভাবে শেষ করা হবে তা নিয়ে চিন্তিত ‘টিউবলাইট’ টিম। 

ওম পুরির মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুইটারে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান ‘টিউবলাইট’র পরিচালক কবির খান। তিনি লেখেন, ‘ওমজি, কিছুদিন আগেই ছবির সেটে আপনি আমাদের সঙ্গে হাসছিলেন। আমরা চলচ্চিত্র জগতের এক অন্যতম অভিনেতাকে হারালাম। আমি রোজ সকালে আপনার থেকে পাওয়া উষ্ণ আলিঙ্গন মনে করব'। এর আগেও কবির খানের ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’ ছবিতে ওম পুরি অভিনয় করেছিলেন।

ওম পুরি

ওম পুরির মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকবার্তা দিয়েছেন বলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও শোক জানিয়েছেন। অমিতাভ বচ্চন টুইট করেছেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না তিনি আর নেই। কয়েকদিন আগেই আমার ‘সরকার-৩’ ছবির শুটিং সেটে এসেছিলেন। এত উৎফুল্ল আর প্রাণোচ্ছল একটা মানুষ কী করে চলে যেতে পারেন!’

ঋষি কাপুর টুইট করেছেন, ‘শান্তিতে থাকো। তোমাকে মিস করব ওম!’ অনুপম খেরের টুইট, ‘৪৩ বছর ধরে ওম পুরিকে চিনি। আমার কাছে সে সব সময়ই দারুণ এক অভিনেতা, হৃদয়বান আর দয়ালু এক মানুষ। আর এভাবেই পুরো পৃথিবীর তাকে স্মরণ করা উচিত।’

শাবানা আজমি টুইট করেছেন, ‘ওম পুরি! তুমি আমাদের বড্ড জলদি ছেড়ে চলে গেলে। আমি খুবই দুঃখিত। সেই সব আনন্দ, হাসিঠাট্টা, তর্কবিতর্ক এখন প্রচণ্ড নাড়া দিচ্ছে মনে। খুব মিস করব তোমায়।’

শাহরুখ খানের টুইট, ‘ঈশ্বরের বাগান নিশ্চয়ই খুব সুন্দর, আর তিনি সেরাটাই বেছে নেবেন। বার্লিনে আপনার সেই প্রাণখোলা হাসিটা খুব মিস করব। ওমজি, আমরা আপনাকে খুব মিস করব।’

অনিল কাপুর টুইট করেছেন, ‘একজন অভিনেতা, শিক্ষক, বন্ধু আর অনন্য হৃদয়বান মানুষ ওম পুরি। কাজের জন্য তীব্র তাড়না আর হৃদয়ের সারল্য তাকে সব সময়ই স্মরণীয় করে রাখবে। আমরা তাকে মিস করব।’

বোমান ইরানী টুইট করেছেন, ‘শান্তিতে থাকুন ওম পুরি। আমরা আমাদের সেরা মানুষটাকেই হারালাম। এক মেধাবী, এক দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। পুরি সাহেব, আমরা আপনাকে মিস করব।’

মাধুরী দীক্ষিত টুইটে বলেছেন, ‘ওম পুরির এই আকস্মিক চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। ‘অর্ধ সত্য’র মতো অনেক কিছুতেই আপনাকে ভালোবাসতাম।'

প্রিয়াংকা চোপড়া টুইট করেছেন, ‘অসামান্য প্রতিভাধর অভিনেতা ওম পুরির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি। ঈশ্বর তার আত্মাকে শান্তি দিন এবং পরিবারকে এই আঘাত সামলে ওঠার শক্তি দান করুন।’

অক্ষয় কুমার, করণ জোহর, মনোজ বাজপেয়ি, রিতেশ দেশমুখ, আনুশকা শর্মা, আলিয়া ভাট, সুশান্ত সিং রাজপুত, সিদ্ধার্থ মালহোত্রা, বরুণ ধাওয়ান, রাজকুমার রাও, হুমা কোরেশি, জ্যাকলিন ফার্নান্দেজ ও আরো বহু তারকা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এই সদ্য প্রয়াত অভিনেতার প্রতি।

ওম পুরি

বর্ষীয়াণ এই অভিনেতার পরবর্তী ছবি ছিল ‘রম্ভাজান জিন্দাবাদ’। এ ব্যাপারে নানা সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছিলেন তিনি। শেষ দু’সপ্তাহ ধরে ওম পুরির সাক্ষাৎকার নেওয়ার টানা চেষ্টা চালাচ্ছিল সংবাদসংস্থা পিটিআই। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। অবশেষে ঠিক হয়েছিল, শুক্রবার বেলা ১১টায় হবে সেই সাক্ষাৎকার। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টা আগেই সব শেষ। হৃদরোগে আচমকা আক্রান্ত হয়ে অজানা দুনিয়ায় পাড়ি দেন ওম পুরি।

বিতর্কিত ওম

ভারতে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা। কিন্তু সেইসঙ্গে জীবনকালে একাধিক বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি।

শহীদদের অপমান করার অভিযোগ
শল্য অভিযান নিয়ে একটি নিউজ চ্যানেলে টকশোতে যোগ দিয়েছিলেন ওম পুরি। ভারতে পাকিস্তানি অভিনেতাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা নিয়ে সেখানে আলোচনা চলছিল। সেখানে ওম পুরি বলেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করার জন্য আমরা কাউকে আমন্ত্রণ জানাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় সেনারা স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছেন এবং তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেই যুদ্ধক্ষেত্রে গেছেন।’ এরপরই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে অবশ্য ক্ষমা ও যা করেছেন, তার জন্য শাস্তি চান তিনি।

দাম্পত্য হিংসার অভিযোগ
স্ত্রী নন্দিতা পুরির সঙ্গে ওম পুরির সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। নন্দিতা তার বই ‘আনলাইকলি হিরো: দ্য স্টোরি অব ওম পুরি’-তে লিখেছেন সে কথা। সেখানে তিনি ওমের যৌন জীবনের অনেক কথা প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি জানান, বাড়ির পরিচারিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ওমের। এছাড়া নন্দিতার বাবার কেয়ারটেকারের সঙ্গেও যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ওম। এছাড়া নন্দিতা দাম্পত্য হিংসার অভিযোগও তুলেছিলেন। ঘটনার পর সাবেক স্ত্রী সীমা কাপুরের কাছে চলে যান ওম পুরি। নন্দিতা ডিভোর্সের মামলা দায়ের করেন। গত বছরের গোড়ার দিকে তাদের ডিভোর্সও হয়ে যায়।    

রাজনীতিবিদরা অশিক্ষিত
রাজনীতিবিদদের অশিক্ষিত বলেছিলেন ওম পুরি। রামলীলা ময়দানে ঘটেছিল ঘটনাটি। তখন ওম পুরি আন্না হাজারের টিমের সদস্য ছিলেন। হাজার হাজার লোকের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে ওম পুরি বলেছিলেন, ‘সাংসদরা অশিক্ষিত। এদের ব্যাকগ্রাউন্ড কী? অর্ধেকের বেশি সাংসদ মূর্খ। আমি টিভিতে দেখি। এরা হাউজে কীভাবে লড়ে!’ ওম পুরির এই বক্তব্যে বিতর্ক ওঠে। এই ঘটনার জন্য পরে তিনি ক্ষমাও চেয়ে নেন। 

গোমাংস নিষিদ্ধ বিতর্ক
২০১৫ সালে দাদরি কেসের সময় ওম পুরি গোমাংস নিষিদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যারা গোমাংসর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তারা ভণ্পডন্ড। আমরা গোমাংস রপ্তানি করে ডলার আয় করি।’ এই মন্তব্যের জন্য ওম পুরি নিজেও সমালোচিত হয়েছিলেন। ওই সময় একটি সংখ্যালঘু  পরিবারের একজনকে গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধে’ হত্যা করা হয়।

নকশালরা যোদ্ধা, সন্ত্রাসবাদী নয়
ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালে প্রকাশ ঝায়ের ছবি চক্রব্যূহর সময়। ওম পুরি তখন বলেন, ‘নকশালরা যোদ্ধা। সাধারণ মানুষের জন্য তারা হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে। ওরা সন্ত্রাসবাদী নয়।’ জেলাশাসক অ্যালেক্স পল মেননের অপহরণের ঘটনায় নকশালদের সমর্থন করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘নকশালরা মেননকে অপহরণ করেছে। কারণ তিনি এমন কিছু করছিলেন যা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে ছিল ।’

অভিনয় জীবনে ওম

বিভিন্ন রকম চরিত্রে স্বচ্ছন্দ অভিনয় দক্ষতা আর গুরুগম্ভীর কণ্ঠঠস্বর - এই দুটোই ছিল ওম পুরির মূল সম্পদ। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা আর তার পরে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করেন ওম। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তিনি। 'ঘাঁসিরাম কোতোয়াল' নামের মারাঠি ভাষায় তৈরি ছবিটি-ই তার অভিনয় করা প্রথম চলচ্চিত্র।

তার পরের চল্লিশ বছরে 'অর্ধ-সত্য', 'সদগতি', 'আস্থা', 'আক্রোশ', 'মির্চ মসালা', 'জেনেসিস' বা 'ধারাভী'র মতো সমান্তরাল ছবিতে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনই বহু হিট বলিউডি বাণিজ্যিক ছবিতেও একই রকম স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। 'ডিস্কো ড্যান্সার' থেকে শুরু করে 'চাচী ৪২০', 'চায়না গেট', 'হেরাফেরি', 'মালামাল উইকলি', ' রং দে বাসান্তি', 'দাবাং'- এর মতো জনপ্রিয় ছবিতেও তাকে দেখা গেছে নানা ধরণের চরিত্রে।

রাজকুমার সন্তোষী, কমল হাসান, সুভাষ ঘাই বা প্রিয়দর্শনের মতো জনপ্রিয় হিন্দি ছবির পরিচালকরাও তাকে রেখেছেন নিজেদের হিট ছবিগুলোতে। আবার 'ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট' বা 'ইস্ট ইজ ইস্ট'-এর মতো আন্তর্জাতিক ছবিতেও কাজ করেছেন ওম পুরি।

সেজন্যই গোটা মুখে বসন্তের দাগ থাকা স্বত্ত্বেও তাকে সত্যজিৎ রায়, গোবিন্দ নিহালনী, শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষরা যেমন নিজের ছবির জন্য ডেকেছেন, তেমনই ডেকে নিয়েছেন 'গান্ধী' ছবির জন্য রিচার্ড অ্যাটেনবরো বা 'সিটি অফ জয়ে'র পরিচালক রোল্যান্ড জফ।

সূত্র: দ্য সান ডট কো ডট ইউকে

সম্পাদনা: সোহেলুর রহমান