(সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিক’) - কিডনিসহ সমগ্র মূত্রনালি বা মূত্রথলিতে পাথরের শিকার হলে অনেকে ঘাবড়ে যান। নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণ করে রোগটিকে জটিল অবস্থায় নিয়ে যান কেউ কেউ। কিডনির পাথর অপসারণে অনেকে শল্য চিকিৎসার কথা শুনে ভয় পান। কেউ আবার বিকল্প চিকিৎসা বা দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর পরিকল্পনাও করে থাকেন। এসব প্রেক্ষাপটে মানুষ যেন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তার জন্যই সাপ্তাহিক মুখোমুখি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ সাজিদ হাসানের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুর রহমান
সাপ্তাহিক: কিডনি, মূত্রথলি বা মূত্রনালিতে পাথর কাদের বেশি হয়?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: আসলে রোগটি যেকোনো বয়সে দেখা দিতে পারে। শিশু-কিশোরদের মাঝে অপুষ্টিজনিত কারণে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বয়সের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।
সাপ্তাহিক: কিডনির পাথর রোগটির প্রধান উপসর্গগুলো কী কী?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: এই রোগের প্রধান উপসর্গ ব্যথা। ব্যথার সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বা লালচে রঙের প্রস্রাব, প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া, ঘোলাটে রঙের প্রস্রাব ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। ব্যথা থেমে থেমে বা কোমর ধরেও আসতে পারে। ব্যথাটি স্থির না থেকে নিচের দিকে নামতেও পারে। ব্যথা তীব্রতর হলে এবং থেমে থেমে আসলে সে ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব এমনকি বমিও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এসব কিছুর সঙ্গে জ্বরও থাকে।
সাপ্তাহিক: এই রোগ উপসর্গ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কীভাবে শনাক্ত করা যায়?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: রোগীর মাঝে উল্লিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিলে ইউরোলজিস্টরা তলপেটের এক্সরে, প্রস্রাব পরীক্ষা, ব্যথার ক্ষেত্রে কালচার করা যেতে পারে। কিডনি এক্সরের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের পাথরের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়া চিকিৎসকরা কিডনির কার্যক্রম ও পাথরের অবস্থান নির্ণয়ে ওঠট নামক এক প্রকার এক্স-রে-এর আশ্রয় নিয়ে থাকেন। (ইউরিক এসিড পাথর ব্যতীত) পেটের আলট্রাসনোগ্রাম এক্ষেত্রে সরাসরি কাজে না আসলেও কিডনির রোগজনিত যে প্রভাব তা জানা সম্ভব হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রক্তের ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন লেভেল রোগের জটিলতা ও কিডনির কার্যক্ষমতা নির্ণয়ে সহায়তা করে।

ডা. মোঃ সাজিদ হাসান
সাপ্তাহিক: এই রোগটি কী ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: এক্ষেত্রে পাথর আকারে ছোট হলে তা বেরিয়ে আসতে পারে এবং জটিলতার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু পাথরটি আকারে বড় হলে মূত্রনালির অংশবিশেষ ফুলে যাওয়া, কিডনিতে প্রদাহ এমনকি কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।
সাপ্তাহিক: এ রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কিছু বলুন?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: কিডনির পাথর বিভিন্ন আকারের হতে পারে। আকৃতির ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে পাথরের আকৃতি ২.৫ সে.মি. বা তার কম হলে এবং কিডনি পরিপূর্ণভাবে কার্যকর থাকলে শক ওয়েভ দিয়েই (ইএসডব্লিউএল) পাথর ভেঙে ফেলা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে না। ভাঙা পাথর প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে আসে। তবে পাথরের আকার বড় হলে (২.৫ সে.মি. -এর বেশি) সার্জারি করতে হয়। আজকাল সম্পূর্ণ পেট না কেটে শুধু পেটে সামান্য ছিদ্র করে সার্জারির মাধ্যমে পাথর বের করে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতির সার্জারিতে রোগীকে বেশিদিন হাসপাতালে অবস্থান করতে হয় না এবং শরীরে কাটা দাগও থাকে না। তবে পদ্ধতিটি একটু ব্যয়বহুল।
সাপ্তাহিক: মানুষের জীবনযাপন প্রণালি কি এই রোগের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: কিডনি, মূত্রথলি বা মূত্রনালিতে পাথর হওয়ার সঙ্গে খাবার এবং সেই সূত্রে চালচলনেরও এক ধরনের ভূমিকা রয়েছে। যারা অল্প পানি পান করে থাকেন তাদের মাঝে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। মাছ-মাংস বা কোনো শাক-সবজির এই রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। বংশগত প্রভাবকেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন না। তবে অঞ্চলভেদে আবহাওয়াগত প্রভাবের সঙ্গে এই রোগের প্রাদুর্ভাবের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়। উচ্চ তাপমাত্রা ও শুষ্ক আবহাওয়ার অঞ্চলের মানুষের মাঝে রোগটি বেশি দেখা যায়।
সাপ্তাহিক: এই ধারণাটি প্রচলিত যে, অধিক পানি পান করলে কিডনিতে পাথর হতে দেয় না। ধারণাটি কি সঠিক?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: না, ধারণাটি একেবারেই ভুল। বরং অতিরিক্ত পানি পানে কিছু জটিলতাও সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, অনেকেই কিডনিতে পাথর হলে বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার রস পান করেন। এর ফলে বরং কিডনির অবস্থা আরও অবনতির পর্যায়ে চলে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
সাপ্তাহিক: কিডনির পাথর অপসারণের জন্য কি আমাদের দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: কিডনির পাথর অপসারণের উন্নত চিকিৎসা এখন আমাদের দেশেই অপেক্ষাকৃত সুলভে সম্ভব। সুতরাং দেশের বাইরে যাবার দরকার নাই।
সাপ্তাহিক: এই রোগ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বা এ সম্পর্কীয় কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে কি?
ডা. মোঃ সাজিদ হাসান: অবশ্যই। কিডনির পাথর প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় ওষুধ নিয়মিত ও পরিমিত পানি পান করা। প্রাপ্তবয়স্ক একজন লোকের প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পানের অভ্যাস করা উচিত। যাদের একবার পাথর হয়েছে তাদের পরিমিত পানির সঙ্গে ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার যেমন দুধ, মাছের মাথা, শুটকি মাছ ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত।
সহযোগিতায়: মোঃ মেহেদী হাসান