ছবি সংগৃহীত

বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টা ও আজকের নারী

প্রিয় ডেস্ক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:২৯
আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:২৯

ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় মতামত বিভাগে নিয়মিত লিখছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সানজিদা মুস্তাফিজ। আজ ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উপলক্ষে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, নারী জাগরণ ও বর্তমান সময়ের নারীর অবস্থান নিয়ে লিখেছেন।

 

বঙ্গভারতে মুসলিম নারীজাগরণের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় একটি নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি একজন মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, নারীবাদী তাত্ত্বিক এবং নারী-শিক্ষার অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলিম নারী সমাজের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রথম প্রবর্তক। তার চিন্তা-চেতনার বিষয় ছিল সমাজে নারীদের পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কারচ্ছন্নতা এবং ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নিয়ে। তাকে ধর্ম, পিতৃতন্ত্র, নারী-পুরুষের বৈষম্যের আক্রমণাত্মক পরিবেশের মধ্য দিয়ে নারীমুক্তির কাজ পরিচালনা করতে হয়েছে। তিনি নারীদের পশ্চাৎপদতাকে ভারতবাসীর উন্নতির পথে অন্তরায় ভেবে তার রচনাবলি ও কাজকর্মের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সমতা আনার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তৎকালীন ধর্মীয় মৌলবাদ, শিক্ষাহীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন। নারী পুরুষের সমন্বয়ে সমাজে সামগ্রিক সত্তা নির্মাণ করার আকাঙ্খায় তিনি নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তার সংগ্রাম ছিল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে না। তিনি নারীকে পুরুষের সমকক্ষ রূপে গণ্য করে তার লেখায় সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন,

আমরা সমাজের অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ কিরূপে উঠিবে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিয়ে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ ও আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে একই। 

তিনি সমাজকে শকটের সাথে তুলনা করেছেন, যে শকটের দুটি চাকা, নারী ও পুরুষ। তাদের উভয়কে সমানভাবে পরিচালনা করলেই সমাজ সঠিকভাবে এগিয়ে যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। বাংলা ও ভারতের সামাজিক সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে মুসলিম নারীদের সম্পৃক্ততায় তার অবদান অনেক। আজ ৯ ডিসেম্বর এ মহিয়সী নারীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী।

বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে তিনি ও তার বোন করিমুন্নেসা খানম বড় ভাইয়ের কাছে লেখাপড়া শিখতেন। সেসময় মুসলিম মেয়েদের শুধু কুরআন শরীফ মুখস্ত করা ছাড়া আর কোনোরকম শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তীকালে ১৮৯৮ সালে তার বিয়ে হয় সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন নামক উদার আদর্শবাদী নারী শিক্ষা প্রসারে উৎসাহী একজন প্রগতিশীল মানুষের সঙ্গে। তার সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমেই পর্দা প্রথায় জর্জরিত মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পর তিনি একক প্রচেষ্টায় নারী জাগরণের মহান কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তার কর্ম ও বর্ণময় জীবনের অবসান ঘটে।

এক সময় ধর্মীয় কুংস্কারের কারণে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে নারীকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না। ধর্মীয় গোড়ামী নারীদের মুক্ত-চিন্তা ও যুক্তিবোধকে স্থবির করে রেখেছিল দীর্ঘদিন ধরে। পরবর্তীকালে উপনিবেশের আশীর্বাদে হিন্দু নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় কিছুটা এগিয়ে গেলেও মুসলিম নারীদের অবস্থার উন্নতি তখনও হয়নি। সে ধরনের পরিস্থিতিতে মুসলিম পরিবার ও সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠলেও রোকেয়া প্রথাগত মুসলিম নারীদের মতো ছিলেন না। নারীদের এগিয়ে নেওয়ার কাজে শুরুতেই তিনি ধর্মের নামে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শিক্ষা, সামাজিক মান-মর্যাদা হতে নারীকে আড়াল করে রাখার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন নারীদের আত্মসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। যাতে করে এই আত্মসচেতনতার মাধ্যমে নারী তার অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পেতে পারে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে বঙ্গীয় রেনেসাঁর প্রভাবে হিন্দু সমাজের মেয়েদের অধঃপতিত অবস্থার উন্নতি হলেও মুসলমান মেয়েরা পর্দা প্রথার অবরোধ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। হিন্দু সংস্কারবাদীরা সমাজে উপেক্ষিত নারীদের নিরক্ষরতা অবসানের জন্য কার্যক্রম শুরু করলেও সেসময় নির্যাতিত মুসলিম নারী সমাজের অগ্রগতির জন্য কোনো মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারক ছিল না। যে কারণে বাঙালি মুসলিম নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক হিসেবে বেগম রোকেয়াকে মর্যাদা দেওয়া হয়। মুসলমান নারীদের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের সাহায্যে ১৯১১ সালে মুসলিম ছাত্রীদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মাত্র আট জন ছাত্রী ও দুইটি বেঞ্চ নিয়ে স্কুল শুরু করলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীকালে যা কলকাতার নাম করা ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল’ নামে পরিচিতি পায়। বেগম রোকেয়া শিক্ষা বলতে প্রকৃত সুশিক্ষাকে বোঝাতেন। তার মতে, শুধু মাত্র গোটা কতক বই পড়তে পারা বা দু’লাইন কবিতা লিখতে পারা শিক্ষা নয়। তিনি চেয়েছিলেন সেই শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীদের নাগরিক অধিকার অর্জনে সক্ষম করে তুলবে। তিনি বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্কশাস্ত্র এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। তবে নীতিশিক্ষা, ধর্মশিক্ষা ও চরিত্র গঠনের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে চেয়েছিলেন। সেসাথে তৎকালীন নারীদের জীবন বাস্তবতার সাথে মিল রেখে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও বেশ কিছু বিষয় তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। যার মধ্যে ছিল শারীরিক শিক্ষা, হস্তশিল্প, সেলাই, রান্না, সেবাদান, গার্হস্থ্য-অর্থনীতি, উদ্যানবিদ্যা প্রভৃতি।

পরবর্তী সময়ে রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলমান নারীদের সংগঠিত না করলে বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখা যাবে না। যে কারণে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করে ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘আঞ্জুমান-ই খাওয়াতিন ইসলাম’ (মুসলমান নারী সমিতি) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এটি ‘ নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ ও ‘Calcutta Mohamedan Ladies’ Association’ নামেও পরিচিত ছিল। নারীর সামাজিক জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে সচেতনতাবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলাই ছিল সংগঠনটির লক্ষ্য। বিশ শতকের শুরুর দিকে যখন মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার মুসলিম সমাজে বিরাজমান ছিল, সে প্রেক্ষাপটে মেয়েদের মায়েদের জন্য সমিতি গঠন করা ও সভা সমিতির মাধ্যমে তাদের সমাজগঠনমূলক কাজে উৎসাহিত করা নিঃসন্দেহে বেগম রোকেয়ার এক অনন্য প্রচেষ্টা ছিল। দীর্ঘদিন কুসংস্কারের আঁধারে আচ্ছন্ন মুসলিম নারী এতটাই অজ্ঞ ছিল যে, সমিতি কি সেটাও বুঝতে পারতেন না। রোকেয়া গল্পচ্ছলে একবার বলেছিলেন,

‘একবার অনেক সাধ্যসাধনার ফলে নানা প্রকার প্রলুব্ধ করিয়া একটি শিক্ষিত মুসলমান পরিবারের মহিলাকে আঞ্জুমানের মিটিংয়ে আনা গেল। যথাসময়ে মিটিংয়ের কাজ শেষ হইল। সমবেত মহিলারা গৃহে ফিরিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। এই সময় নবাগতা মহিলাটি রোকেয়ার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, সভার নাম করিয়া বাড়ীর বাহির করিলেন, কিন্তু সভা তো দেখিতে পাইলাম না।’

সমাজগঠনমূলক কাজ, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের উৎসাহিত করাই ছিল এ সংগঠনের উদ্দেশ্য। সংগঠন করতে গিয়ে অনেক বিদ্রুপ আর পরিহাসের শিকার হয়েও রোকেয়া কাজকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে তহবিল গঠন করে দরিদ্র ছাত্রীদের, অসহায় কুমারী ও বিধবা নারীদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার মতো কাজ পরিচালিত হতো। সমিতি থেকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ না করলেও বেগম রোকেয়া রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। ১৯১৭ সালের কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন উপলক্ষ্যে যে সেচ্ছাসেবিকা বাহিনী হঠিত হয়েছিল, সে দলে বহু মুসলিম নারী যোগদান করেছিল। এছাড়াও রোকেয়ার নেতৃত্বে স্বদেশি ও খেলাফত আন্দোলনেও এ সমিতির নীরব কর্মতৎপরতা ছিল। ‘নিখিল ভারত মহিলা সমিতি’র একজন নিষ্ঠাবান সদস্য ছিলেন রোকেয়া। এর মাধ্যমেও তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করে গেছেন। সেইসঙ্গে ‘Bengal Women’s Education Conference’ এর একজন বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে তিনি নারীশিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে কাজ করেছেন। এভাবে বিশ শতকের শুরু থেকে তিনি আমৃত্যু বিরামহীনভাবে সমাজসেবা করে গেছেন। 

বিশ শতকের প্রথম দশকেই বেগম রোকেয়া তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজে নারীর অধঃপতিত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করার কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে জীবনের অনুভূতি, সমাজ বাস্তবতা ও নিজ আকাঙ্খাকে তুলে ধরেছেন। তার লেখায় তিনি সমাজ ও জাতির কল্যাণের জন্য নারীর শিক্ষিত ও সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা উল্লেখ করেন। মূলত নারীর আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলা, অর্থনৈতিক মুক্তির আবশ্যিকতা ও নারীর মানসিক দাসত্বের অবসানের প্রয়োজনীয়তা ছিল তার লেখার উপজীব্য বিষয়। রোকেয়ার রচনাবলীতে তৎকালীন সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিক মতাদর্শের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য ও জাতিগোষ্ঠীগত সংকটের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। সেইসঙ্গে তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মুসলিম নারীর প্রতি অসম আচরণের বিষয়সমূহকেও তিনি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি চিহ্নিত করেন কীভাবে ধর্মকে ব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিম নারীদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সামাজিক ও ধর্মীয় বিবেচনায় নারীদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ও নারীদের মানুষ হিসেবে দেখার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার সাহিত্য জীবনের শুরু ‘পিপাসা’ (১৯০২) নামক গল্প দিয়ে এবং শেষ ‘নারীর অধিকার’ (১৯৩৩, বইটি সমাপ্ত করার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন) শীর্ষক রচনার মধ্য দিয়ে। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে-  মতিচূর (প্রবন্ধ, ২ খণ্ড, ১৯০৫ ও ১৯২২) যার ১ম খণ্ডে আছে ৭টি প্রবন্ধ আর ২য় খণ্ডে আছে ‘সৌরজগৎ’, ‘ডেলিসিয়া হত্যা’,‘জ্ঞান-ফল’, ‘নারী-সৃষ্টি’, ‘নার্স নেলী’, ‘মুক্তি-ফল’সহ ১০টি নানাবিধ রচনা; Sulrana’s Dream  (নকশাধর্মী রচনা, ১৯০৮), পদ্মরাগ (উপন্যাস, ১৯২৪), অবরোধবাসিনী (নকশাধর্মী গদ্যগ্রন্থ, ১৯৩১) । এছাড়া নারীমুক্তির প্রয়াসে রচিত বাংলা ও ইংরেজিতে তার অসংখ্য চিঠিপত্র রয়েছে যার মাধ্যমে তার কর্মতৎপরতার বর্ণনা পাওয়া যায়। বেগম রোকেয়া নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনাকালে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও গোড়ামীর বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ভাবধারা প্রচার করেন তার বিভিন্ন প্রবন্ধতে। ১৯০৩ সালে নারীকল্যাণ ও নারীমুক্তির লক্ষ্যে রচনা করেন ‘অলঙ্কার না Badge of Slavary’ নামক প্রবন্ধ। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় মতিচূর (১ম খন্ড) নামক সাতটি প্রবন্ধ সংযুক্ত একটি সংকলন গ্রন্থ। সমাজের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি মুসলমান নারীদের দুঃখ-দুর্দশা ও সমাজের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। মতিচূর (১ম খন্ডের)  প্রবন্ধ ‘স্বপ্নের স্ত্রীজাতির অবনতি’তে রোকেয়া ধর্ম নিরপেক্ষ, যুক্তিনির্ভর ও বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। উক্ত প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন,

‘শিশুকে মাতা বলপূর্বক ঘুম পাড়াইতে বসিলে, ঘুম না পাওয়ায় শিশু যখন মাথা তুলিয়া ইতস্ততঃ দেখে, তখনই মাতা বলেন : ‘ঘুমা শিগ্গির ঘুমা! ঐ দেখ সু সু!’ ...‘সেইরূপ আমরা যখনই উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, অমনিই সমাজ বলেঃ ‘ঘুমাও, ঘুমাও, ঐ দেখ নরক।’

এছাড়াও প্রবন্ধটিতে রোকেয়া বিদ্যমান ধর্মীয় আদর্শের ভিন্নতা সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করে লিখেছেন,

‘দূতগণ ইউরোপে যান নাই। কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমনী’ জাতিকে নরের অধীনে থাকিতে হইবে’ এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর?...’ 

১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয় তার Sulrana’s Dream নামক ইংরেজি বই। এই রচনায় তিনি অদ্ভূত এক নারী জগতের কল্পনা করেছেন যেখানে পুরুষ পর্দার আড়ালে গৃহকোণে আবদ্ধ আর নারী রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, সুযোগ সুবিধা লাভ করলে নারীরা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। এখানে তিনি নারীর ওপর পুরুষের প্রভূত্বের বিষয় এবং নারীদের হীনমন্যতা দূর করে নিজ প্রতিভা ও গুণাবলী সম্পর্কে সচেতন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত পদ্মরাগ উপন্যাসের মূল কথা ছিল নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা অবরোধবাসিনী। সর্বমোট ৪৭টি কাহিনী সংযুক্ত করে এ গ্রন্থে তিনি ভারতবর্ষের অবরোধবাসিনী নারীসমাজের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রোকেয়া এ গ্রন্থে ‘পর্দা’ ও ‘অবরোধে’র মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। তিনি বিমূর্ত এক শালীনতাবোধ ও সে বোধজনিত রুচিশীল পোশাক পরাকে ‘পর্দা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর পর্দা প্রথার বিকৃতির মাধ্যমে নারী জাতিকে অন্ধকার অন্তঃপুরে আবদ্ধ রেখে সবধরনের বহিঃস্পর্শ থেকে তাদের বঞ্চিত করার আচার এবং আদর্শকে তিনি দেখিয়েছেন ‘অবরোধ’ হিসেবে। একজন ধর্মানুরাগী মুসলিম নারী হিসেবে রোকেয়া যেমন পর্দার পক্ষে শাস্ত্রীয় যুক্তি প্রদান করেছেন তেমনি আবার তিনি ‘পর্দাকে’ ব্যাখ্যা সাপেক্ষও করে গেছেন। কারণ তিনি পর্দাকে নারীর জন্য নিপীড়নমূলক হাতিয়ারে পরিণত করতে চাননি। অনেক ক্ষেত্রে তার লেখায় ধর্মীয় রক্ষণশীল উক্তি লক্ষ্য করা যায়। অনেক লেখায় তিনি ধর্মীয় ব্যবস্থার অর্থাৎ ইসলামের সুদিক নিরূপণ করেছেন। মূলত ইসলাম কিভাবে নারীদের দুর্দশা কাটিয়ে সমাজে পরিবর্তন সাধন করেছিল এবং পার্থিব-অপার্থিব সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার দিয়েছে তার দিকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সর্বপরি তার লেখার মাধ্যমে তিনি বাংলার মুসলিম নারী সমাজে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেলেন। তৎকালীন উদার চেতনাসম্পন্ন অনেক মনীষী রোকেয়ার মহতী কাজগুলোতে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা The Mussalman, মহিলা, নবনূর, সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, ভারত মহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, নবপ্রভা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ইত্যাদি পত্রিকা তার কাজকে এগিয়ে নিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এসকল পত্রপত্রিকা বিভিন্ন সময়ে তার রচিত কবিতা, প্রবন্ধ, অভিভাষণ  ইত্যাদি মুদ্রিত করে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বেগম রোকেয়া নারীসমাজের সনাতন জীবনধারা পরিবর্তন করে তাদেরকে একটি আত্মনির্ভর ও মর্যাদাশীল শ্রেণী হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গভারতের কিংবা এ দেশের নারীসমাজের বিকাশমান ধারায় তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শিক্ষাকে নারী জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তার যুগ ছিল নারীশিক্ষার সূচনালগ্ন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এসেছে নানান পরিবর্তন। শিক্ষার হার বেড়েছে তবে নারীদের অবস্থান তেমন বদলায়নি। সমাজে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা আজও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারে এখনও মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হয় ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে পুঁথিগত বিদ্যা অনেক অর্জিত হলেও রোকেয়া নাগরিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যে স্বশিক্ষার কথা উল্লেখ করেছিলেন তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত। একবিংশ শতকের শুরুতে এখনও নারী অধিকার সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। বর্তমান নারীমুক্তি ও নারী অধিকার আন্দোলনের যুগে বেগম রোকেয়া নারীদের সামনে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অনন্য আদর্শ। তিনি নারীদের প্রতি হওয়া সমস্ত অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নারী নির্যাতনের চিত্র বর্তমানে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণার রিপোর্টে দেখা যায়, এ দেশের প্রায় ৮৭% নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। এ ছাড়া ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, খুন, পাচার, ফতোয়াবাজি, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে বা লোক চক্ষুর অন্তরালে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকের বিরুদ্ধেও বেগম রোকেয়া প্রতিবাদ করেছিলেন। এ বিষয়গুলো আজও সমাজে নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নিয়ামক হিসেবে রয়েছে। তবে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রোকেয়া যে প্রতিবাদ করে গেছেন, তার সুফল পরবর্তীকালে কিছুটা হলেও এসেছে। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, নারী নির্যাতন দমন আইন ১৯৮৩, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, কিংবা সাম্প্রতিক কালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের অনুমোদিত খসড়া, এসবই নারী আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলস্বরূপ। রোকেয়া নারীদেরকে সমাজের ক্ষমতা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 

‘পুরুষের সমদক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব, আবশ্যক হইলে লেডি কেরানি হইতে লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ সবই হইব।’

এ দিক থেকে বলা যায়, তার স্বপ্ন অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবখানে নারীদের অবস্থান লক্ষণীয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারী সকল কর্মক্ষেত্রেই বিচরণ করছে। আমাদের দেশে নারী জজ, নারী ব্যারিস্টারের পাশাপাশি নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের প্রধান নারী হলেও নারীর সার্বিক মুক্তি এসেছে তা এখনও বলা যাবে না। রোকেয়ার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নারীদের এ আন্দোলনের ধারাকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যেদিন সমাজ সকল ধরনের গোড়ামী, কুসংস্কারচ্ছন্নতার উর্ধ্বে উঠে চিন্তা-চেতনা, কর্মে নারীকে পুরুষের সমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মূল্যায়ন করতে পারবে, সেদিনই রোকেয়ার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে সফল হবে।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]