
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র: দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পরিণতি
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত এবং ইসরায়েলের আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ইরানের একটি বা একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সংবাদ এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন ও সম্প্রতি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় সম্ভাব্য হামলার মাধ্যমে সংঘাত এখন এমন এক পথে এগোচ্ছে, যা ভবিষ্যতের ভূরাজনীতিকে আমূল বদলে দিতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে আগেই শত্রুতা বিদ্যমান ছিল, এখন তা সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। ইরান তার প্রক্সি গোষ্ঠি যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসকে সক্রিয় করেছে। ইসরায়েলও সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়েছে এবং আক্রমণাত্মক মোডে প্রবেশ করেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই যুদ্ধ কি বিজয়ের গল্প হবে, নাকি এক দীর্ঘস্থায়ী “ওয়ার অব এট্রিশন” এর মাধ্যমে কিছু রাষ্ট্র, তাদের ভূখণ্ড, অর্থনীতি ও সভ্যতা ধ্বংস হবে? বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েল ঠিক সেই পথেই হাঁটছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধটিকে আর একটি সীমিত দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছে না, বরং এটিকে একটি আঞ্চলিক মহাযুদ্ধে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
প্রেক্ষাপট
ইসরায়েল বহু বছর ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে, ইরান মনে করে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে তার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে। গত ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে ইরান, সিরিয়া ও লেবাননে ইরানি ঘাঁটিতে ইসরায়েলের টার্গেটেড স্ট্রাইক এবং পরে ২২ জুন ২০২৫ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার খবর পরিস্থিতিকে নাটকীয়ভাবে উত্তপ্ত করে তোলে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল হচ্ছে আমেরিকার একটি প্রক্সি দেশ, যার মাধ্যমে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা দখল নেয়ার একটা মহাপরিকল্পনা করেছে। সাথে আছে ইসরায়েলের ‘জায়োনিজম’ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা শুধু একটি সামরিক হামলা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য এবং বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য এক চরম উত্তেজনাকর ও বিপজ্জনক মোড়। এই ধরনের একতরফা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা একটি "point of no return" পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। একে আর স্বাভাবিক কূটনীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এই হামলা বিশ্বকে নিয়ে যেতে পারে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ, যার পরিণতি হতে পারে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে তিনটি সম্ভাব্য পরিণতি
ইসরায়েলের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য পতন : ইসরায়েলের যে-কোনো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জয়লাভের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কারণ একটাই—কৌশলগত গভীরতার অভাব (Strategic Depth)। ইসরায়েল একটি ছোট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ রাষ্ট্র। একটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে তার অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে, শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তারা পরমাণু হামলা চালিয়ে শেষ মুহূর্তে শত্রুকে ধ্বংসের চেষ্টা করতে পারে। তবে তা কেবল চূড়ান্ত ধ্বংস নিশ্চিত করতে পারে, বিজয় নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—ইসরায়েলিদের দ্বৈত নাগরিকত্ব। প্রায় সাত লক্ষ ইসরায়েলি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে ইসরায়েল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা বাড়লে এই দ্বৈত নাগরিকেরা পশ্চিমে ফিরে যাবেন এবং আর ফিরবেন না। ফলে জনবলের দিক থেকেও ইসরায়েল দুর্বল হয়ে পড়বে।
ইরানের প্রতিরোধ যুদ্ধ: ইরান শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, এটি একটি বিপ্লবের ফসল। ইসলামি বিপ্লবের পর এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর ইরান ৪০ বছর ধরে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো প্রচলিত অস্ত্রে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। জিপিএস বা স্যাটেলাইটেও এসবের অবস্থান নিশ্চিতভাবে ধরা যায় না। একমাত্র উপায় স্থল অভিযান—কিন্তু ইরানের ভৌগোলিক গঠন, পর্বতমালা ও ঘনসংখ্যক প্রতিরোধশক্তি এ অভিযানের জন্য এক দুর্ধর্ষ ফাঁদ।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যেই জাতিসংঘের কোনো অনুমোদন ছাড়াই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন ‘মিডনাইট হ্যামার’এর ব্যানারে গত ২২ জুন ২০২৫ তারিখে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র ফোর্ডো (Fordow), নাতানজ (Natanz) এবং ইসফাহান (Isfahan) এ ব্যয়বহুল বিমান আক্রমণ করেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এই হামলাকে “ব্যাপক সাফল্যময়” এবং “অসাধারণ সফলতা” বলে অভিহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৫০টির বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যার অনেকগুলো ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন ও কাতারে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরায়েলের পাশে অবস্থান নিয়ে ইরানকে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র নয়, বরং হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- যুদ্ধ ও সংঘাত
- ইরান-ইসরায়েল সংকট