
বিশ্বের নীরব সংকটগুলো আমরা কি ভুলে যাব
বিশ্ব তার উচ্চকিত সংকটগুলো মোকাবিলায় আজ সোচ্চার, যেমন ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি যুদ্ধ, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত, ইউক্রেনের লড়াই ইত্যাদি। উচ্চকিত সংকটের উত্তপ্ত স্থানগুলোয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান। মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের শরণার্থী প্রশ্নেও।
আজ বিশ্বের ১২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু ও ছিন্নমূল। যুদ্ধ, সংঘাত, সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা কাঠামো ভেঙে পড়ার কারণে কয়েক কোটি মানুষ ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
২০ জুন ‘বিশ্ব শরণার্থী দিবস’ পালনের মধ্য দিয়ে আমরা দুনিয়ার সব শরণার্থীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছি এবং প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি যে ‘শুধু কথা নয়, কাজ প্রয়োজন’। কিন্তু অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে, বুভুক্ষা এবং সম্ভবত দুর্ভিক্ষ যে একটি নিশ্চুপ দুর্যোগ হিসেবে বিশ্বের ১৩টি সংকটস্থলে আবির্ভূত হচ্ছে, সেই ব্যাপারে বিশ্বের কোনো খেয়াল নেই। কারণ, নীরব সংকটগুলো প্রায়ই মানুষের মনোযোগ বলয়ের বাইরে অবস্থান করে।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের ১৩টি সংকটকেন্দ্রে প্রায় ১৬ কোটি লোক তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। ১৩টি দুর্যোগস্থল হচ্ছে বুরকিনা ফাসো, চাদ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, গাজা, হাইতি, মালি, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, সুদান, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেন। এখানে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।
এক. খাদ্যসংকটকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই আফ্রিকা মহাদেশে (১৩ সংকটস্থলের ৮টিই আফ্রিকায়)। দুই. আফ্রিকার সংকটস্থলগুলোর কোনো কোনো জায়গায় খাদ্যসংকট দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগতভাবে বিরাজ করছে। নানা সময়ে এটি দুর্ভিক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। তিন. খাদ্যসংকটের শিকার মোট ১৬ কোটি লোকের অর্ধেকের বেশি (৯ কোটি) তিনটি দেশের বাসিন্দা—নাইজেরিয়া (৩ কোটি), গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী কঙ্গো (সাড়ে ৩ কেটি) ও সুদান (আড়াই কোটি)। চার. দেশ থেকে দেশান্তরে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ব্যাপ্তি ও প্রকৃতি ভিন্নতর এবং একটি দেশের মধ্যেও বিভিন্ন অঞ্চলে এর বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। কোনো কোনো খাদ্যসংকট মাঝারি ধরনের, কোথাও কোথাও এ সংকট তীব্রতর এবং কোনো কোনো জায়গায় এ সংকট দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। পাঁচ. খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা শেষ পর্যন্ত পুষ্টিনিরাপত্তাহীনতায় রূপান্তরিত হয়, যার মূল শিকার হয় শিশু।
একটি সমাজে নানা কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। খাদ্যসংকটের ১৩ জায়গার মধ্যে ১২টিতেই সশস্ত্র সহিংসতা তীব্র খাদ্য দুর্যোগের মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার তীব্র সংকটস্থলগুলো বিস্তৃত এবং ক্রমবর্ধমান সশস্ত্র সহিংসতা খাদ্যনিরাপত্তার অবস্থাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো দেশে (যেমন সুদানে) চলমান সংঘাতের সঙ্গে খরা মৌসুম মিলে স্থায়ী দুর্ভিক্ষসদৃশ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
গাজা এলাকায় দু–দুটি কারণে ব্যাপ্ত দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে—এক. ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী সামরিক সংঘর্ষের কারণে এবং ত্রাণ সংস্থাগুলোর কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে। অপর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অভিগমনের সুযোগের অভাব ত্রাণকাজের মূল অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দক্ষিণ সুদানে প্লাবন হচ্ছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতেও অসুবিধা রয়েছে। এসব কারণের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সহিংসতা ও রাজনৈতিক উত্তেজনা মিলে দেশটির খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেখানে সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা এবং দুর্বল মুদ্রামান প্রধান প্রধান খাদ্যসামগ্রীর মূল্য গত বছরের তুলনায় পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে গৃহস্থালির ক্রয়ক্ষমতা বহুলাংশে কমে গেছে।
হাইতিতে গ্যাং-সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতার চরম বৃদ্ধি মানুষকে ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুতিতে বাধ্য করেছে, মানবিক ত্রাণকার্যে বিঘ্ন ঘটছে। এ কারণে রাজধানীর আশপাশে ছিন্নমূল মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘটে। মালির চলমান সংঘাত এবং উত্তর ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অভিগমনে চরম অন্তরায়ের কারণে খাদ্যব্যবস্থা ক্রমাগতভাবে বিঘ্নিত হতে থাকে এবং সহায়তা প্রদান কষ্টকর হয়ে ওঠে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, উচ্চ ঋণভার, ভূরাজনৈতিক নাজুকতা ও বাণিজ্য বিপর্যয়ের কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বিশ্বের সংকটকেন্দ্রগুলোয় আরও তীব্রতর হয়েছে। বিশ্বের নানা অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ বৈশ্বিক খাদ্য জোগানব্যবস্থার নাজুকতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সুদানে সংঘাতের কারণে ২০২৫ সালে দেশটির ভেঙে পড়া অর্থনীতিটিকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি জনগণের খাদ্যলভ্যতা আরও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও কর্মনিয়োজনের সুযোগের বিলুপ্তি ফিলিস্তিনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে আরও সংকুচিত করবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- উদ্বাস্তু
- শরণার্থী সঙ্কট
- বাস্তুচ্যুত