আগে স্থানীয়, পরে বিদেশি বিনিয়োগ

www.ajkerpatrika.com আবু তাহের খান প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২৫, ১৩:১৪

সমাপ্তপ্রায় অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, এ সময়ে দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ২৮.৭৯ শতাংশ ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে ২৫.৫৬ শতাংশ। প্রায় একই ধরনের অর্থনৈতিক প্রবণতার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যরোও (বিবিএস)। তাদের তথ্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং এর অনিবার্য ফল হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও ছিল গত ২৫ বছরের মধ্যে নিম্নতম। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, একই সময়ে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্র হয়ে পড়বে এবং সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২.৯ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। আর দেশে মূল্যস্ফীতির হারও বহুদিন ধরেই ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে, যা মে মাসে ছিল ৯.৫ শতাংশ এবং শিগগির তা কমবে বলেও মনে হচ্ছে না, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সেপ্টেম্বর নাগাদ তা ৭ শতাংশে নেমে আসার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আর সদ্য অনুমোদিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের নতুন বাজেটে এ হার আরও কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।


উল্লিখিত নিম্নধারার বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও দারিদ্র্য পরিস্থিতির মুখে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে এই মুহূর্তে সবার আগে করণীয় হচ্ছে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং অবশ্যই তা শুরু করতে হবে স্থানীয় বিনিয়োগ দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা তাদের যাত্রা শুরুর একেবারে প্রথম দিন থেকেই স্থানীয় বিনিয়োগকে উপেক্ষা করে বৈদেশিক বিনিয়োগ উন্নয়নের নামে দেশ-বিদেশ চষে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তাতে ফল না মিললেও সেটিকেই তারা নিজেদের দক্ষতা ও কর্মতৎপরতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। অথচ বিষয়টি শুধু ভ্রান্তিপূর্ণই নয়—বড় মাত্রার ক্ষতিরও কারণ বটে। আর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই স্টারলিংকের মতো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দেশের জন্য কতটা লাভজনক, সে প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠতে শুরু করেছে এবং ধারণা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে এ-জাতীয় প্রশ্নের সংখ্যা ও ব্যাপ্তি দুই-ই আরও বাড়বে। মানুষ তখন সরাসরি জানতে চাইবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির নাম করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যে বিশাল অপচয় তারা ঘটিয়েছে, তা ঘটানোর এখতিয়ার তাদের আছে বা ছিল কি না।


দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নে স্থানীয় বিনিয়োগকে জোরদার করার পথে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দেশে একটি নির্বাচিত নিয়মিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে না থাকা। এমনটি না থাকার কারণে সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তাদের কেউই অন্য পেশা বা কাজে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে শিল্প বা ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার সাহস বা উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। যাঁরা উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মরত আছেন, তাঁরাও নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে প্রতি মুহূর্তে নানাবিধ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ভুগছেন, যা মোটেও অবস্তুনিষ্ঠ নয়। সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করে ফেলেছে। কিন্তু সে বাজেটের আওতায় ঘোষিত নানা লক্ষ্যমাত্রা, কর ও শুল্কহার, প্রণোদনা ও ভর্তুকি, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য ইত্যাদি বছরের শেষ অবধি ঘোষণা অনুযায়ী বহাল থাকবে কি না, তা কেউই নিশ্চিত নয়। বরং গত অর্থবছরের বিপুল রাজস্ব ঘাটতির ধরন ও পরিমাণ এ আশঙ্কাকে প্রতি মুহূর্তে অধিক ঘনীভূত করে তুলছে, সরকারকে হয়তো অনেকটা নিরুপায় হয়েই অর্থবছরের কিছু সময় পেরোতে না পেরোতেই এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।



এরূপ একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে নতুন ও বিদ্যমান উভয় বিনিয়োগ নিয়েই যে স্থানীয় উদ্যোক্তারা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ভুগবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, সরকার স্থানীয় উদ্যোক্তাদের এ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে একেবারেই বুঝতে পারছে না কিংবা পারলেও রহস্যজনক কারণে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না। বরং এর বিপরীতে তারা তথাকথিত বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে ও বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে জাঁকজমকপূর্ণ বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছে, স্টারলিংকের মতো বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নতুন করে বাড়তি প্রণোদনার জন্য কমিটি গঠন করেছে ইত্যাদি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ছায়াটিও তারা মাড়াতে চাইছে না। বিষয়টি শুধু স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্যই হতাশাব্যঞ্জক নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে বড় ধরনের সংকটে ফেলার মতো পরিস্থিতিও এটি। ফলে অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের আশু কর্তব্য হবে বৈদেশিক বিনিয়োগের পেছনে না ঘুরে স্থানীয় বিনিয়োগকে জোরদার করার প্রতি মনোযোগী হওয়া।


প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার পরিপ্রেক্ষিতে এর সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতির ওপর। এই মুহূর্তে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আরও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তরুণেরা বিদেশে পাড়ি জমানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। নইলে বিরাজমান বেকারত্ব পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ত। তরুণদের এ বিদেশগামিতা দেশকে মেধাশূন্য করে ফেলছে বলে আক্ষেপ থাকলেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তারা যা করছে, সেটিকে বাধাদানের নৈতিক শক্তি এ রাষ্ট্রের নেই। বরং বৃহত্তর জন-অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচার জন্য এটিই এখন রাষ্ট্রের জন্য অন্যতম লাগসই কৌশল। মনঃকষ্টের কারণ থাকলেও তরুণদের বিদেশগামিতাকে উৎসাহদান ও এ প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তোলার জন্যই বরং এখন বর্ধিত বিনিয়োগ ও তৎপরতা করা দরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন কৌশলই এখন হওয়া উচিত বিদেশে যেতে উৎসাহিত করা এবং এর গমনপদ্ধতিকে যতটা সম্ভব দক্ষ ও গতিশীল করে তোলা।


দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই মুহূর্তে যদি দুর্নীতি ও মবমুক্ত পরিবেশে দক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা না যায়, তাহলে শুধু সংস্কারের কথা বলে অর্থনীতির নিম্নমুখিনতাকে খুব বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এটি করার জন্য নতুন কোনো দাওয়াই প্রয়োজন নেই। বরং উদ্যোক্তাদের এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান চাহিদাগুলোকে জটিলতা ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশে দিতে পারলেই কাজটি হয়ে যায়। কিন্তু প্রত্যাশিত নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তাদের নানা অনানুষ্ঠানিক ব্যয় যেভাবে হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে করে বৈদেশিক তো পরের কথা, স্থানীয় বিনিয়োগই-বা বাড়বে কেমন করে? দেশে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছে তাদের ‘শুভার্থী চাঁদা’র দাবিও জোরদার হয়ে উঠছে। এমনি পরিস্থিতিতে মব, মামলা কিংবা অন্য হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য উল্লিখিত চাঁদা পরিশোধ করে ব্যবসা ও শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কতটা লাভজনক হতে পারে, তা একটি প্রশ্ন আছে বৈকি! তবে এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, এসব সমাধান করতে না পারলে স্থানীয় বিনিয়োগ কিছুতেই বাড়বে না। আর স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বৈদেশিক বিনিয়োগের আশা একেবারেই অবান্তর।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও