ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশের ঐতিহ্য পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার : শাঁখারিদের অস্তিত্ব সংকট

farzana rinky
লেখক
প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০১৪, ১০:৪১
আপডেট: ১১ আগস্ট ২০১৪, ১০:৪১

(প্রিয়.কম) : পুরান ঢাকা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা। আর এই এলাকাটিতেই রয়েছে ঐতিহাসিক শাঁখারিবাজার। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর কাছে ইসলামপুর রোড ও নওয়াবপুর রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই এলাকায় বসবাসকারী শাঁখারিদের নামানুসারেই এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে শাঁখারিবাজার। শাঁখারিরা বংশগত ভাবে শাঁখা তৈরির কাজে নিয়োজিত। শাঁখা, সিঁদুর থেকে শুরু করে পূজার যে কোনো সামগ্রী পাওয়া যায় এ বাজারে। একসময় ঢাকা বিখ্যাত ছিল শাঁখারিদের তৈরী শাঁখার জন্য, যা এখনও বহন করে চলেছে সেই ঐতিহ্য।

শাঁখারিদের ইতিহাস :

রাজধানী ঢাকার প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো এই এলাকার ইতিহাস ঘাঁটলে জেমস ওয়াইজের ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের এক বর্ণনা অনুসারে জানা যায়, ঢাকায় সেসময় ৮৩৫ জন শাঁখারি বসবাস করতেন। ধারণা করা হয়, দেড় হাজার বছর আগে বল্লাল সেনের শাসনামলে শাঁখারি বাজারের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে। এই শাঁখা শিল্পটাও দক্ষিণ ভারতেই উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। শাঁখারিরা বাংলাদেশে প্রথমে বসতি গড়ে তোলেন ঢাকার বিক্রমপুরে। পরে সেখান থেকে ঢাকার বর্তমান শাঁখারি পট্টি অর্থাৎ শাঁখারি বাজারে শাঁখারিরা তাদের বসতি গড়ে তোলেন। এরপর থেকে প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাঁখারিদের বিস্তৃতি ঘটে। বর্তমানে বরিশাল, শরিয়তপুর, রূপসা, সাতক্ষিরা, খুলনা, পাবনা, নাটোরের জামনগর, টাঙ্গাইলের অলোয়া, মুন্সিগঞ্জের বকজুড়ি, ফরিদপুরের মধুখালি প্রভৃতি অঞ্চলে শাঁখারি সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। সপ্তদশ শতকের মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথান এর লেখায় শাঁখারিবাজারের উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী শাঁখারি বাজার গুড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর শাঁখারিরা আবার এসে বসবাস শুরু করেন এই শাঁখারি বাজরে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হিন্দু বসবাস করছেন শাঁখারি বাজারে। শাঁখারি বাজারের বর্তমান শাঁখারিরা প্রিয়.কমকে জানান, তারা শুধু তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ত্রৈলক্যনাথ ধর এবং সাগর সুরের মতো প্রথিতযশা শাঁখা শিল্পী এবং ব্যবসায়ীর কথা স্মৃতিতে আনতে পারেন। তাঁরা সাতচল্লিশের দেশ ভাগের আগে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ভারতের বাগ বাজারে এখনও ত্রৈলক্যনাথের বংশধররা এই ব্যবসা ধরে রেখেছে।

শাঁখারিবাজারের শাঁখা শিল্প :

শাঁখা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহামূল্যবান। শাঁখা ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে অসম্ভব। শাঁখা হচ্ছে শঙ্খ দিয়ে তৈরি এক ধরনের সাদা অলঙ্কার। পুরাণে আছে, শঙ্খাসুরের স্ত্রী তুলসী দেবী ছিলেন ভগবান নারায়ণে বিশ্বাসী এক সতীসাধ্বী নারী। আর শঙ্খাসুর ছিল ভগবানবিমুখ অত্যাচারী। তার (শঙ্খাসুর) পাপের শাস্তিস্বরূপ তাকে বধ করার পর ভারত মহাসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীব্রতী তুলসী দেবী তা সইতে না পেরে স্বামী এবং নিজের অমরত্বের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। ভগবান প্রার্থনা মঞ্জুর করে তার দেহ থেকে তুলসী গাছ এবং সমুদ্রে হত্যা করা স্বামীর রক্ত ও অস্থি থেকে শঙ্খ বা শাঁখার উৎপত্তি করেন। তুলসী দেবীর ধর্মপরায়ণতায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান দু'জনকেই ধর্মীয় কাজে নির্ধারণ করে দেন। সেই থেকে পতিব্রতা তুলসীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তুলসী ও শাঁখা ব্যবহারের প্রচলন হয়। শঙ্খকে হিন্দু রমণীর সতীত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।

শাঁখা শিল্পটি নির্মাণে শাঁখারিদের নিপুণতা :

শাঁখাশিল্পের মূল উপকরণ সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ, যা শ্রীলঙ্কার জাফনা ও ভারতের চেন্নাইয়ের তিতপুরে পাওয়া যায়। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য যেসব প্রজাতির শঙ্খ বা শামুক ব্যবহৃত হয় সেগুলো হচ্ছে: তিতপুটি, রামেশ্বরি, ঝাঁজি, দোয়ানি, মতিছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটি, এলপাকারপাটি, নায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, তিতকৌড়ি, জাহাজি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপটি ও আলাবিলা। এগুলোর মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সর্বোৎকৃষ্ট। এরপরেই জাডকি ও পাটি শঙ্খের স্থান। আর আলাবিলা শঙ্খ হচ্ছে সবচেয়ে নিম্নমানের। ১৯১০ সালে ১৫০টি তিতকৌড়ি শঙ্খের মূল্য ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ১৯৯৯ সালে যার মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় চৌদ্দ হাজার থেকে ত্রিশ হাজার টাকায় আর বর্তমানে তা দাঁড়ায় মহামূল্যে। বিভিন্ন মাপের শঙ্খবলয় তৈরি করতে শিল্পীরা ২.৫ থেকে ৪ ইঞ্চি ব্যাসের শঙ্খ ব্যবহার করে থাকেন। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরিতে আর যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে: করাত, তেপায়া টুল, হাতুড়ি, নরুন ইত্যাদি। বর্তমানে শঙ্খ কেটে বলয় বের করার জন্য প্রাচীন আমলের করাতের পরিবর্তে বিদ্যুতচালিত এক ধরণের গোলাকার করাত ব্যবহার করা হয়।
ভালো আকৃতির একটি শঙ্খ থেকে মাঝারি ধরনের সর্বোচ্চ ৪টি এবং সরু ধরনের ১০টি শাঁখা পাওয়া যায়। শাঁখা কেটে বের করার পর সেগুলোর ভেতর ও বাইরের দিক মসৃণ করে তাতে বিভিন্ন নকশা তোলা হয়। এসব নকশার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, ধানের শীষ, মাছ, পাখি ইত্যাদি মোটিফ। একটি শাঁখা তৈরি করতে শিল্পীকে মোট ১২টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আবার হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও জলের দ্রবণের সাহায্যে উজ্জ্বল করে তার গায়ে বিভিন্ন নকশা এঁকে এক ধরণের বিশেষ শঙ্খ তৈরি করেন শাঁখারিরা যাকে জলশঙ্খ বলে। তবে শাঁখারিদের বর্তমান প্রজন্ম আর এই কাজে আসতে চান না। তারা এখন পড়াশোনা, অন্য পেশা এবং অন্যান্য ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছেন। শাঁখারিদের অনেকেই এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত। বলতে গেলে তারা প্রায় আগ্রহই হারিয়ে ফেলছেন এই শিল্পে। কাঁচামালের অভাব, আমদানীকারকের অভাববোধই তাদেরকে এ শিল্প থেকে সরে আসতে বাধ্য করছে। এই প্রসঙ্গে বয়োজেষ্ঠ্য শাঁখারী বিদ্যুত কুমার নাগ বলেন, ‘আমাদের সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নাই। কারণ শাঁখার কাঁচামাল আমাদের দেশে আসে শ্রীলঙ্কা থেকে। এই কাঁচামালের আমদানির ওপর সরকার ৪০ শতাংশ কর ধার্য করে। যেখানে ভারতে এর হার ৫ শতাংশ।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এটি একটি ধর্মীয় উপকরণ তবুও সরকার এর ওপর কর কমায় না।’

বর্তমানে শাঁখারিদের অস্তিত্ব সংকট :

বেশ কয়েকবছর ধরেই শাঁখারিবাজারে অবস্থিত শাঁখারিদের এক ধরনের অস্তিত্ব সংকট নিয়ে মিডিয়া জগতে আলোচনা উঠেছে। বাংলাদেশ সরকার শাঁখারিবাজার এলাকাকে হেরিটেজ এলাকা হিসেবে ঘোষণার পরে তা সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে হস্তান্তর করেন। শাঁখারিবাজারকে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল। এর আওতায় শাঁখারিবাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার এবং পয়ঃনিষ্কাশনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগেও হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভয় দেখিয়ে পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারে একটি সম্পত্তিসহ মন্দির দখলের অভিযোগ উঠেছিল সরকার সমর্থক সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে। শাঁখারিবাজারের একজন বয়োঃপ্রবীণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রচন্ড আক্ষেপের সাথে বলেন, ‘শাঁখারিবাজার একটি হেরিটেজ এলাকা। প্রায় ৫ বছর আগে একবার এটি ভাঙার কথা হয়েছিল। কিছু অংশ ভেঙেও ফেলা হয়। সে সময় সরকার পুরো এলাকাকে হেরিটেজ ঘোষণা করায় তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এরপরে আবারও ভবনটি ভাঙার চক্রান্ত হচ্ছে যার সঙ্গে একজন সরকার সমর্থক নেতা জড়িত। সর্বোপরি এই শাঁখারিবাজারকেই উচ্ছেদ করে দেয়ার এক ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। তাঁতী বাজারে যেমন এখন আর তাঁতীদের অস্তিত্ব নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে স্বর্ণের দোকানপাট তেমনি এই শাঁখারিবাজার থেকেও শাঁখারিদের উচ্ছেদ করতে চাইছে ষড়যন্ত্রকারীরা।’ শাঁখারিবাজারকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণার প্রস্তাবের বিষয়ে বিদ্যুৎ কুমার নাগ বলেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক জমিদার বাড়ি আছে যেগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলোকে সরকার ধরে রাখেনি। যা উচিৎ ছিল। আর এখন, সরকার কারও কারও কুপরামর্শে আমাদের পৈত্রিক আবাস থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। আর তাই দীর্ঘদিনব্যাপী শাঁখারিদের এই অস্তিত্ব সংকটের কারণেই আজ হুমকীর সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শাঁখাশিল্পটি।’