
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী
ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) সঙ্গে স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তির আওতায় অনুমোদিত ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়করণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার অবসান ঘটেছে। আগামী জুনে অনুমোদিত ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি বাবদ ১৩০ কোটি ডলার বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হতে পারে।
আর্থিক সংকট সামাল দিতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফের ঋণ অনুমোদনকালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেভাবে ঋণ চেয়েছে, সংস্থাটি সেভাবেই ঋণ অনুমোদন করেছে। তার এ বক্তব্য মোটেও সঠিক ছিল না। কারণ বাংলাদেশ নিশ্চয়ই শর্তযুক্ত ঋণ চায়নি।
কিন্তু আইএমএফ তো বাংলাদেশকে শর্তমুক্ত ঋণ অনুমোদন করেনি। আইএমএফ এমনই একটি আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী সংস্থা, যারা কোনো দেশকেই শর্তহীন ঋণ দান করে না। তবে ঋণদানের শর্ত দেশভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। দুর্বল দেশগুলোর ক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণের শর্ত তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়। আর যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, তাদের ক্ষেত্রে ঋণের শর্ত তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে থাকে।
২০২২ সালের আগ পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। ফলে সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তা পরিপালনের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। উল্লেখ্য, আইএমএফ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণদানের ক্ষেত্রে যেসব শর্তারোপ করে, তার অন্যতম একটি হচ্ছে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদান না করা। কিন্তু বাংলাদেশ বিগত দিনগুলোতে কৃষি খাতে বর্ধিত হারে ভর্তুকি প্রদান করে এসেছে। প্রতিবছর কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। আইএমএফ ২০২২ সালে বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়করণ করা হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত তিন কিস্তিতে বাংলাদেশ ২৩১ কোটি ডলার ঋণ ছাড় পেয়েছে। আরও ২৩৯ কোটি ডলার ঋণের কিস্তি ছাড়করণ বাকি আছে। আগামী মাসে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ ছাড়করণ করা হবে। অনুমোদিত ঋণের আর মাত্র ১০৯ কোটি ডলার অবশিষ্ট থাকবে।
আইএমএফের শর্তানুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং সেক্টরের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির শর্ত আরোপিত হয়েছিল। সরকার রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউকে (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠন করেছে। এনবিআর তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছিল না, যে কারণে রাজস্ব আদায়ের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। বর্তমানে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিু। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে শুধু এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ চালু করা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। একইসঙ্গে রাজস্ব নীতিমালা সহজীকরণ করতে হবে।
আইএমএফের ঋণচুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি বাস্তবানুগ করা। বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত গ্রস ভিত্তিতে এ হিসাবায়ন করত। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে যে অর্থ এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে ঋণ হিসাবে দেওয়া হয়েছে, তাকেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবে প্রদর্শন করা হতো। কিন্তু আইএমএফের বক্তব্য হচ্ছে, যে অর্থ ফান্ডে জমা নেই এবং চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যায় না, তা কখনোই রিজার্ভ হিসাবে গণ্য হতে পারে না। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদও একই মতপ্রকাশ করেন। বর্তমানে ইডিএফ এবং অন্যান্য প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে আইএমএফের পরামর্শ মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক নিট বেসিসে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবায়ন করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেছে। আইএমএফের হিসাবায়ন পদ্ধতি (বিপিএম-৬) অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সনাতন পদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ২৫ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া কাতার থেকে এলএনজি আমদানির বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং প্রবাসী আয় ইতিবাচক ধারায় থাকার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বর্তমানে অনেকটাই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে।
আইএমএফের শর্ত পরিপালন করে স্ফীত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্ফীতিকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ বৃদ্ধি করে। ফলে আহরিত রেমিট্যান্সের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২০২৫) প্রথম ১০ মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেছে। অতীতে কোনো পুরো অর্থবছরেও এত বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরিত হয়নি। এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছিল।