
ছবি সংগৃহীত
প্রিয় টেকটক: তামিম শাহরিয়ার সুবিন
আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০১৬, ০৩:৪৫
পাইকন ২০১৪
(প্রিয়টেক) বাংলাদেশী প্রোগ্রামারদের কাছে একটি জনপ্রিয় নাম তামিম শাহরিয়ার সুবিন। বাংলাদেশী প্রোগ্রামারদের জন্য সহজ বাংলা ভাষায় তিনি লিখেছেন বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের জনপ্রিয় সব বই। শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং শিক্ষা দেয়া জন্য খুলেছেন ওয়েবসাইটসহ ইউটিউব চ্যানেল। বাংলায় প্রোগ্রামিং শিক্ষা দেয়াসহ কাজ করছেন গণিত অলিম্পিয়াডে মেন্টর হিসাবে। ছিলেন (২০০৭ ও ২০০৮ সালে) এসিএম আইসিপিসি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার ঢাকা রিজিওনাল এর বিচারকও। এ সকল বিষয় সহ, সমসাময়িক ও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একান্তে বিস্তারিত কথা বলেছেন প্রিয়.কমের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুবর রহমান সুমন।
প্রিয়টেক : বর্তমানে কোথায় কাজ করছেন ?
তামিম শাহরিয়ার : বর্তমানে আমি সিঙ্গাপুর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্র্যাব এ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছি। এখানে আমি মূলত একটি টিম পরিচালনা করি। আমাদের কাজ বেশ চ্যালেঞ্জিং। ব্যাকএন্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাশাপাশি স্কেলেবিলিটি ও অ্যালগরিদম নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হয়। গ্র্যাব হচ্ছে একটি ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যাটফর্ম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশের তিরিশটি শহরে আমাদের অপারেশন রয়েছে। আমাদের মূল সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্ট সেন্টার সিঙ্গাপুরে অবস্থিত। তবে চীনের বেইজিং ও আমেরিকার সিয়াটল শহরেও আমাদের সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্ট সেন্টার রয়েছে।
প্রিয়টেক : আপনি ৯ বছরের বেশি সময় ধরে পেশাদার সফটওয়্যার ডেভেলপার, কোন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে আপনি কোড করতে ভালবাসেন ও কেন?
তামিম শাহরিয়ার : আমার পছন্দ পাইথন, কারণ পাইথনে কাজ করা সহজ। তবে প্রফেশনাল কাজে যখন যেটা প্রয়োজন, সেটা শিখে নিয়ে ব্যবহার করি। যেমন গ্র্যাবে যোগ দেওয়ার পরে গোল্যাঙ্গ ব্যবহার করছি। এর আগে আমি পেশাদার কাজে অ্যাকশন স্ক্রিপ্ট, পাইথন, পিএইচপি, পার্ল - এসব ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করেছি। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। প্রোগ্রামিংয়ের বেসিক ঠিক থাকাই আসল ব্যাপার। আমি যেমন আমার প্রথম চাকরিতে পার্ল ব্যবহার করতাম। কিন্তু ওই কোম্পানীতে যোগ দেওয়ার আগে আমি এই ল্যাঙ্গুয়েজ জানতাম না। ইন্টারভিউতেও এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই। দ্বিতীয় চাকরিতে পিএইচপি (পরে অ্যাকশন স্ক্রিপ্ট) ব্যবহার করেছি। সেগুলোও সেই অফিসে জয়েন করার পরে শিখেছি। গ্র্যাবের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এখানে যোগ দেওয়ার আগে কোনোদিন গোল্যাঙ্গ ব্যবহার করি নি। কোনো একটা (বা একাধিক) ল্যাঙ্গুয়েজে দক্ষতা অর্জন করা ভালো, কিংবা কোনো একটা ল্যাঙ্গুয়েজ পছন্দ করাও ভালো। তাই বলে ‘আমি জাভা নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ব’, ‘পাইথন নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ব’, ‘পিএইচপি নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ব’ - এভাবে যারা চিন্তা করে, তারা ঠিক পথে যাচ্ছে না।
প্রিয়টেক : পেশা হিসাবে কেন সফটওয়্যার ডেভেলপার বেছে নিলেন?
তামিম শাহরিয়ার : আমি যেসব কাজ করতে পারি (যেমন শিক্ষকতা, লেখালেখি, প্রোগ্রামিং), সেগুলোর মধ্যে প্রোগ্রামিং করেই সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করা সম্ভব আমার পক্ষে। এছাড়া কাজটি করে আমি অনেক আনন্দও পাই।
প্রিয়টেক : আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
তামিম শাহরিয়ার : আমার ডাকনাম সুবিন। জন্ম ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর ময়মনসিংহে। লেখাপড়া করেছি হোমনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এ কে উচ্চ বিদ্যালয়, নটর ডেম কলেজ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পাস করি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে একটি দেশি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি।
প্রিয়টেক : আপনি একজন তুখোড় প্রোগ্রামার। প্রোগ্রামিং এর প্রতি আগ্রহ জন্মালো কিভাবে?
তামিম শাহরিয়ার : যখন প্রোগ্রামিং সম্পর্কে জানলাম, মনে হলো যে কাজটি আনন্দের এবং এখানে কেউ নাম্বার দিয়ে বিচার করতে আসবে না (মানে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মতো)। আর মুখস্থ করার ব্যাপারও নেই। তাই প্রোগ্রামিং ভালো লেগে গেলো। তবে আমি আসলে তুখোড় প্রোগ্রামার নই। মোটামুটি ভালো প্রোগ্রামার।
ছবি : গ্র্যাবে হ্যাকাথনে টিমের সাথে
প্রিয়টেক : আপনি পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা, লেখক ও শিক্ষাকর্মী। কোন পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
তামিম শাহরিয়ার : পরিচয় নিয়ে আসলে মাথা ঘামাই না। তবে একটা ঘটনা বলি। এবারে (২০১৬ সালে) এসিএম আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস অনুষ্ঠিত হয় থাইল্যান্ডের ফুকেটে। তো আমিও সেখানে সাস্টের অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোচ ও সহকারী কোচ হিসেবে দুইজন শিক্ষক এসেছিলেন। তাঁরা সাস্টের শিক্ষক সাইফুল সাইফকে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করছেন :
- উনি কি আপনাদের কোচ?
- না, উনি
- আচ্ছা, ট্রেইনার?
- না, উনি আমাদের
- ও, ফ্যাকাল্টি?
- না, উনি আমাদের সুবিন ভাই।
প্রিয়টেক : একজন সফল প্রোগ্রামার হওয়ার মূলমন্ত্র কি কি বলে আপনি মনে করেন?
তামিম শাহরিয়ার : অনেক বেশি সময় ধরে কয়েক বছর চর্চা করতে হবে। প্রবলেম সলভিংয়ে দক্ষতা থাকতে হবে, ডিসক্রিট ম্যাথ, ডাটা স্ট্রাকচার ও অ্যালগরিদম ভালোভাবে জানতে হবে। আর সেই সাথে একটি বা দুটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে দক্ষতা। এটুকুই হচ্ছে ভালো প্রোগ্রামার হওয়ার মূলমন্ত্র। আর ভালো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে ভালো প্রোগ্রামার তো হতেই হবে, সেই সাথে অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং ও ডিজাইন, ডিজাইন প্যাটার্ন ও ওয়েব কনসেপ্টস্, সিকিউরিটি - এসব বিষয়ে ভালো ধারণা থাকা লাগবে।
প্রিয়টেক : বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং শেখানোর জন্য আপনি ইউটিউব বা আপনার ওয়েবসাইটে আপনি তুমুল জনপ্রিয়। কিভাবে এই মহান উদ্যোগ নিলেন সেই গল্প শুনতে চাই
তামিম শাহরিয়ার : কিভাবে এই উদ্যোগ নিলা��, সেটি বলতে গেলে ইন্টারভিউ অনেক বড় হয়ে যাবে। তারচেয়ে উদ্যোগগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে বলি।
http://subeen.com : এখানে আমি নিজে এবং অন্য আরো কয়েকজন বাংলায় বিভিন্ন আর্টিকেল লিখে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচুর গাইডলাইন রয়েছে এসব লেখায়। এছাড়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, টেকনোলজি জগতের গুরুদের কথা, বিভিন্ন প্রযুক্তি - এসব নিয়েও লেখা আছে। সামনে আরো কিছু নতুন লেখা যোগ হবে।
http://cpbook.subeen.com : এখানে আমার কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বইয়ের ইন্টারনেট সংস্করণ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া আছে। এছাড়া বাংলায় অনেকগুলো প্রোগ্রামিং সমস্যা দেওয়া আছে, যেগুলো শিক্ষার্থীরা সমাধান করে জমা দিলে তাৎক্ষণিক উত্তর পেয়ে যাবে। এসব সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আমার “৫২টি প্রোগ্রামিং সমস্যা ও সমাধান” বইতে। ওয়েবসাইট থেকে আমার বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড করার লিঙ্ক ও সি প্রোগ্রামিং নিয়ে আমার দেওয়া ভিডিও লেকচারও রয়েছে। ইতিমধ্যে ওয়েবসাইটটিতে দুই মিলিয়নের বেশি পেজভিউ হয়েছে।
http://programabad.com : এটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং প্রশ্নোত্তরের ওয়েবসাইট। শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের প্রশ্নের সর্বোত্তম উত্তরটি খুঁজে পায়, সেজন্যই এই ওয়েবসাইট। ইতিমধ্যে এক হাজারেরও বেশি প্রশ্নোত্তর এখানে আছে।
http://dimikcomputing.com : এখানে দ্বিমিক কম্পিউটিংয়ের অনলাইন কোর্সগুলো আছে। এখন পর্যন্ত যতগুলো কোর্স আছে, সবগুলোই বিনামূল্যে।
http://dimik.pub : বাংলা ভাষায় বাজারে প্রযুক্তি বিষয়ক অনেক বই পাওয়া গেলে তাদের মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মতামত থেকেই আমার এই ধারণা। বাংলা ভাষায় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্বমানের বই প্রকাশ করার লক্ষ্যেই আমরা তৈরি করি দ্বিমিক প্রকাশনী। বইয়ের কেবল কনটেন্ট নয়, ছাপার মানও ইতিমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
https://www.facebook.com/computerprogrammingbook : এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রোগ্রামিংকে আমরা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করি। এর ফলোয়ারের সংখ্যা সাড়ে চার লক্ষ।
https://www.facebook.com/groups/programming.school : এই গ্রুপে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে প্রোগ্রামিং নিয়ে আলোচনা করে। অনেক প্রফেশনালও রয়েছেন এই গ্রুপে।
ছবি : ছেলে আরাভের সঙ্গে সমুদ্রের তীরে
প্রিয়টেক : আপনার ওয়েবসাইট বা বই পড়ে যারা প্রোগ্রামিংয়ে নতুন তারা কিভাবে উপকৃত হতে পারে?
তামিম শাহরিয়ার : আমার বই কিংবা লেকচার কিন্তু খুব সহজ না। সবকিছু আমি মুখে তুলে খাইয়ে দিতে পছন্দ করি না। আমি কাউকে প্রোগ্রামিং শেখাতে চাইলে যেভাবে শেখাতাম, আমার বইগুলোও সেভাবে লেখা। শুধু পড়লেই হবে না, চিন্তা করাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেটা আমি পাঠকদের করতে উৎসাহিত করি। প্রোগ্রামিংয়ের জগতটা বিশাল। আর এই জগতে কেউ আসলে তার শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার বই ও ওয়েবসাইটে (http://cpbook.subeen.com) সেই চেষ্টাই করেছি, প্রোগ্রামিং শেখার সঠিক রাস্তাটা (মানে আমার মতে যেটা সঠিক আর কী) দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
প্রিয়টেক : নতুন প্রোগ্রামারদের জন্য কি গাইড লাইন দিবেন ?
তামিম শাহরিয়ার : নতুন প্রোগ্রামারদের জন্য তো এক-দুই কথায় গাইডলাইন দেওয়া সম্ভব নয়। তাদের জন্য আমি আমার ওয়েবসাইটে (http://subeen.com) অনেকগুলো আর্টিকেল লিখেছি, সেগুলো পড়তে হবে। এছাড়া ‘প্রোগ্রামিং ক্যারিয়ার গাইডলাইন: এক ডজন প্রোগ্রামারের কথা’ নামে আমি একটি বইও লিখেছি। সেখানে ১২জন তুখোড় বাংলাদেশী প্রোগ্রামারের থেকেও বেশ কিছু গাইডলাইন আছে। বইটি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাজে লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস।
প্রিয়টেক : বাংলাদেশ সম্প্রতি এসিএম আইসিপিসি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বিশেষ সফলতা দেখিয়েছে। এটি কিভাবে দেখছেন?
তামিম শাহরিয়ার : সম্প্রতি এসিএম আইসিপিসি প্রতিযোগিতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ছয়টি সমস্যার সমাধান করে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু সাস্ট ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। আমাদেরকে আরো ভালো করতে হবে। আরো অধিক সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওয়ার্ল্ড ফাইনালসে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে ভালো ফলাফল করতে হবে। এজন্য কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ পর্যায়েই প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করে দিতে হবে।
প্রিয়টেক : বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা কিভাবে প্রোগ্রামিং বা এ পেশায় আরো সফলতা দেখাতে পারে?
তামিম শাহরিয়ার : আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি স্কুল-কলেজে আরো ভালোভাবে লেখাপড়া করে, বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান - এসব বিষয়ে সময় নিয়ে বুঝে বুঝে পড়ে, তাহলে ওরা প্রোগ্রামিং করতে আসলে সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে। আর প্রোগ্রামিং শেখার সময় শিক্ষকের আশায় বসে থাকলে হবে না। নিজ উদ্যোগেই শিখতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে।
ছবি : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রামিং আড্ডায়
প্রিয়টেক :বাংলাদেশে কিভাবে প্রোগ্রামিংকে আরো জনপ্রিয় করা যায়?
তামিম শাহরিয়ার : বাংলা ভাষা প্রোগ্রামিং বিষয়ক কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। সমগ্র বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করলে আসলে বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং শেখার বিকল্প নেই। এছাড়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজভিত্তিক প্রোগ্রামিং ক্লাব তৈরি করতে হবে। সারা দেশে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। এসব কাজের জন্য কারো মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকলে হবে না। নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। এই বিষয়ে মহেশপুরের ছেলেমেয়েদের একটি উদ্যোগ প্রশংসনীয় (ফেসবুক নোটের লিঙ্ক )। আর সবশেষে, সারা বাংলাদেশে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিতে হবে। আর সেটা সস্তাও হতে হবে। প্রতি মাসে ১০০-২০০ টাকায় যেন ১০ জিবি ডাটা ব্যাবহার করা যায়, এবং অবশ্যই নূন্যতম ১ এমবিপিএস গতিতে।
প্রিয়টেক : গণিত অলিম্পিয়াডে মেন্টর হিসাবে আছেন কয়েক বছর। এ বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
তামিম শাহরিয়ার : গণিত অলিম্পিয়াডে দীর্ঘ সময় ব্যায় করেছি। সেটি অত্যন্ত সুখকর ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। ২০১১ সালে আমি দুটি গণিত ক্যাম্প পরিচালনা করেছিলাম, যেগুলো ছিল প্রাইমারি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য। ওদের মধ্যে দুইজন এবারের জাতীয় গণিত দলে ছিল, যারা হংকংয়ে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়েছিল। এটি আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। তবে এই অভিজ্ঞতা আমার নতুন হয়। সাস্টের শিক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ে যখন সিলেটে প্যারালাল ম্যাথ স্কুল শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে আমার দুই শিক্ষার্থীও বড় হয়ে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলে ছিল। আমি আশা করবো, দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী গণিত চর্চা করবে। প্রতি বছর আইএমও-তে মেডেল আনার মতো কয়েকশ শিক্ষার্থী থাকবে। সেখান থেকে দল নির্বাচন করতে গিয়ে নির্বাচকদের ঘাম ছুটে যাবে।
প্রিয়টেক : বাংলাদেশে এখন CSE কে জাতীয় সাবজেক্ট বলা হয়। কিভাবে দেখন এ বিষয়টি? এ বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে বাংলাদেশের পেক্ষাপটে এত শিক্ষাথীর জব সেক্টর নিয়ে আপনার মুল্যায়ন ?
তামিম শাহরিয়ার : সিএইস পাশ করে কিন্তু কেউ কেউ বাংলাদেশেই ৬০-৭০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি পায়, আর কেউ কেউ ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরিও পায় না। আর বিশ্বের বড় বড় সফটওয়্যার কোম্পানীগুলো কত বেতন দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রোগ্রামারদের নিয়ে যায়, সেকথা তো শ্রদ্ধেয় কায়কোবাদ স্যার সবসময়ই বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়টাতে ফ্রিল্যান্সিং কিংবা অ্যাপ ডেভেলাপমেন্ট করে সময় নষ্ট না করে সবারই প্রোগ্রামিং প্রবলেম সলভিংয়ে সময় দেওয়া উচিত। হ্যাঁ, আবারো বলছি, সব কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থীদেরই কমপক্ষে প্রথম দুই বছর প্রবলেম সলভিং ও প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করা উচিত। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার জন্য সিরিয়াসলি প্র্যাকটিস করলে যতটুকু প্রোগ্রামিং শেখা হবে, সেটা অন্যভাবে সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাপী ভালো প্রোগ্রামারদের অনেক চাহিদা। এজন্য বিশুদ্ধ প্রোগ্রামিং চর্চাই একমাত্র উপায়, ফ্রিল্যান্সিং কিংবা মোবাইল অ্যাপ ডেভেলাপমেন্ট নয়। CSE পড়লে তো ভালো, কিন্তু পড়তে এসে প্রোগ্রামিং শিখতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর প্রোগ্রামিং শিখে নিজেকে যদি তারা বিশ্বমানের প্রোগ্রামার হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে কেবল দেশের সফটওয়্যার খাতেরই উন্নতি হবে না, সেই সাথে নর্থ আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মিডল ইস্ট, সব জায়গাতেই আমরা দাপিয়ে বেড়াব। দেশের অর্থনীতিতেও বিরাট অবদান রাখা সম্ভব হবে।
প্রিয়টেক :বর্তমানে বাংলাদেশী শিক্ষাথীদের প্রোগ্রামিং শেখানোর জন্য কি কি উদ্দ্যোগ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাই ?
তামিম শাহরিয়ার : দ্বিমিকের পক্ষ থেকে কিছু কার্যক্রম চলছে। যেমন নতুন অনলাইন কোর্স (মূলত ভিডিও লেকচার) ও বই বের করার কাজ। এগুলোই মূলত চলবে। এবছর আমার কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ হবে দুয়েকমাসের মধ্যেই। এছাড়া বেসিক গ্রাফ অ্যালগরিদম ও জাভা প্রোগ্রামিং নিয়েও দুইজন বই লিখেছেন - এগুলোও শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এছাড়া কিছু অনলাইন কোর্স তৈরির কাজও চলছে। তাই চোখ রাখতে হবে http://dimik.pub ও http://dimikcomputing.com ওয়েবসাইটে।
ছবি : সিলেটের জাতীয় হাই স্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্টে শিক্ষক ও প্রিয় মানুষ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে
প্রিয়টেক : আপনার ডেভালপ করা কিছু জনপ্রিয় সফ্টওয়্যার নিয়ে বিস্তারিত বলুন ?
তামিম শাহরিয়ার : আমি আসলে একা তেমন কোনো সফটওয়্যার তৈরি করি নি, তাই আমার একার তৈরি কোনো জনপ্রিয় সফটওয়্যারও নেই। এই কথা শুনলে অনেকেই অবাক হবে, কারণ তাদের ধারণা প্রোগ্রামিং শেখার পরেই প্রোগ্রামারের কাজ হচ্ছে এটি সফটওয়্যার তৈরি করা, যেটি কী না হতে পারে ডেস্কটপ অ্যাপ কিংবা মোবাইল অ্যাপ। এই ধারণা ভুল। আমি যেমন বেশ কিছু বড় সফটওয়্যার প্রজেক্টে কাজ করেছি, অবশ্যই কোনো টিমে। ফেসবুক প্ল্যাটফর্মের গেম, বড় মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাকএন্ড তৈরি করা (যাকে অনেকে সার্ভার সাইড প্রোগ্রামিং বলে) আমার কাজ। তাই আমি আবারও বলব, প্রোগ্রামিং শিখেই সফটওয়্যার তৈরি (যেটি দিয়ে আসলে অনেকে বোঝায় যে গ্র্যাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস ভিত্তিক সফটওয়্যার) করার জন্য অস্থির হয়ে যাওয়ার কিছু নেই। এর চেয়ে প্রবলেম সলভিং করা, ডাটা স্ট্রাকচার ও অ্যালগরিদম শেখা ও চর্চা করা, এগুলোই অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রিয়টেক : আপনাদের “Code it, girl!” সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
তামিম শাহরিয়ার : কোড ইট গার্ল আসলে আমার সাবেক সহকর্মী ও বন্ধুদের উদ্যোগ। আমি মেন্টর হিসেবে তাদের সাথে রয়েছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা মেয়ে, তাদের কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়তে আসার প্রবণতা ছেলেদের তুলনায় কম। আবার যারা আসে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহী হয় না। তাই মেয়েদের প্রোগ্রামিং ভীতিটা দূর করা ও তাদেরকে প্রোগ্রামিং আকৃষ্ট করাই এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। এজন্য অনলাইনে নিয়মিত সাহায্য করা ছাড়াও মাঝে মাঝে ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা হয়। ফেসবুক পেজের লিঙ্ক
প্রিয়টেক : বিশেষ কিছু বলার আছে ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে?
তামিম শাহরিয়ার : বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং চর্চার যেই আন্দোলন আমরা শুরু করেছি, তাতে সাথে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আসলে অনলাইনে বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং কোর্স তৈরি করা, বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং বই লেখা - এগুলো খুবই ক্ষুদ্র কাজ। কিন্তু সবার সমবেত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন বিষয়টিকে একপ্রকার আন্দোলনের মতোই পরিণত করেছে। তাই এই কৃতিত্ব শিক্ষার্থীদের। আশা করি, তারা নিজেরা প্রোগ্রামিং চর্চা চালু অব্যাহত রাখবে, অন্যদেরও প্রোগ্রামিং শেখার পথটা চিনিয়ে দিতে সাহায্য করবে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়, তোমাদের যত কষ্টই হোক না কেন, ফ্রিল্যান্সিং করবে না, বরং ভালোভাবো প্রোগ্রামিং চর্চার পেছনে সময় দেবে। টাকা-পয়সার দরকার হলে টিউশনি করতে পারো, তাও ফ্রিল্যান্সিং নয়। একসময় বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক দক্ষ প্রোগামার তৈরি হবে, যাদের মধ্যে কমপক্ষে দশ হাজার হবে আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার প্রকৌশলী। তারা দেশের বড় বড় প্রজেক্টে কাজ করবে, নর্থ আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর - এসব দেশেও হবে তাদের জয়জয়কার। বাংলাদেশের অর্থনীতির চতুর্থ স্তম্ভটি হবে এই সফটওয়্যার খাত। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।