ছবি সংগৃহীত

তড়িৎচৌম্বকীয় তত্ত্বের জনক ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এর জন্মদিন আজ

মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান
লেখক
প্রকাশিত: ১৩ জুন ২০১৩, ০৫:৫৮
আপডেট: ১৩ জুন ২০১৩, ০৫:৫৮

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল মূলত উনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের উপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল যা অন্য কোন বিজ্ঞানীর ছিল না। আর তাই তাঁর নামটি উচ্চারিত হয় অন্য দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও নিউটনের নামের সাথে। বিজ্ঞানী নিউটনের পরে যত বিজ্ঞানীর দেখা পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে ম্যাক্সওয়েলই ছিলেন সব চেয়ে সফল। ম্যাক্সওয়েল সারা জীবনে শতাধিক গবেষণাপত্র রচনা করেছেন। এগুলো মূলত বর্ণবিজ্ঞান, আণবিক তত্ত্ব ও তড়িৎচৌম্বকীয় তত্ত্ব এই তিনটি বিষয়ের উপর ছিল। ম্যাক্সওয়েলের জীবনের সব থেকে বড় আবিষ্কার ছিল তড়িৎচৌম্বকীয় তত্ত্ব। এই আবিষ্কারের ফলেই পরবর্তীতে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রেডিও উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছিল। ম্যাক্সওয়েল ছিলেন বহু গুনের অধিকারী। তিনি যে শুধু গবেষণার কাজ করতেন তা নয়। একাধারে তিনি ছিলেন একজন নামকরা সাঁতারু, দক্ষ শরীরচর্চাবিদ। ঘোড়দৌড়েও তাঁর ছিল বিশেষ দক্ষতা। অবসর সময়ে তিনি কবিতা লিখতেন এবং নিয়মিত কবিতা লেখার চর্চা করতেন। ম্যাক্সওয়েলের জন্ম হয়েছিল ১৮৩১ সালের ১৩ জুন ব্রিটেনের এডিনবার্গ শহরের উপকণ্ঠে। তাঁর বাবা ছিলেন এডিনবার্গ শহরের একজন ধনী মানুষ। ম্যাক্সওয়েলের বাবা এবং মা অনেক দেরিতে বিয়ে করেন। ম্যাক্সওয়েল যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন তাঁর মায়ের বয়স হয়েছিল ৪০ বছর। ম্যাক্সওয়েলের জন্মের পর এডিনবার্গের বাড়িটি তারা ছেড়ে দেন। কিছুদিন পর অর্থাৎ ম্যাক্সওয়েলের বয়স যখন প্রায় আট তখন তাঁর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন তারা ছিলেন মিডলবাই এস্টেটে তাদের নিজস্ব বাড়িতে। ম্যাক্সওয়েলের মা মারা যাবার পর তাঁর বাবা তাকে মাতৃস্নেহে মানুষ করেন। ম্যাক্সওয়েলের নিজস্ব বাড়িটি ছিল বিশাল। এই বিশাল বাড়িটি আসলে ছিল একটি খামার বাড়ি। তাদের খামার বাড়ির আশেপাশে ছিল প্রচুর গাছগাছালি। জঙ্গলে ফুটে থাকত নানা রঙের ফুল। তাঁর আশেপাশের পাহাড়, হ্রদের জলরাশি, নদীর অবিরাম ছুটে চলা দেখে তিনি অবাক হতেন। তাঁর কৌতূহলী মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিত। তিনি ভাবতেন প্রকৃতির এত রূপের উৎস কি। তিনি নিজে অনুসন্ধান করতেন তাঁর প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্য। যা পরবর্তীতে তাকে বিজ্ঞানী হতে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতির মাঝে থাকার কারণে ম্যাক্সওয়েল হয়ে ওঠেন প্রকৃতি প্রেমী। এমন প্রকৃতি প্রেমী মূলত কবি হয়। তিনি হয়েছিলেন ও তাই। তাঁর অনেক গুনের একটি গুণ হল তিনি কবিতা লিখতেন। কিন্তু তাঁর এই কবি পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে তাঁর বিজ্ঞানী পরিচয়। তিনি বিজ্ঞানের এমন কিছু আবিষ্কার করেন যা তাকে স্মরণীয় করে রাখে। তাঁর আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব। ম্যাক্সওয়েল ছিলেন অসম্ভব মেধার অধিকারী। খুব কম বয়স থেকে তাঁর মেধার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। ম্যাক্সওয়েলের বয়স যখন ১৪ বছর তখন তিনি গণিত এবং জ্যামিতির সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করেন। জ্যামিতির একটি জটিল সমস্যার নাম কার্টেসিয়ান ওভাল। এটি মূলত জ্যামিতির এক ধরণের বক্রতা বিষয়ক সমস্যা। তিনি এই সমস্যার একটি উন্নত সমাধানের জন্য কাজ করেন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সফলতা লাভ করেন। তিনি কার্টেসিয়ান ওভালের একটি উন্নত গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। কিশোর বয়সে ম্যাক্সওয়েল জ্যামিতির প্রতি প্রচণ্ড আসক্ত ছিলেন। তাঁর অধিকাংশ সময় কাটত জ্যামিতি নিয়ে। এই বয়সেই তিনি জ্যামিতির বৃত্ত নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর এই রচনাটি তখনকার বিজ্ঞানী মহলে সমাদৃত হয় এবং এটি এডিনবার্গের রয়েল সোসাইটি থেকে পুস্তকারে প্রকাশিত হয়। ১৫ বছরের বালক কর্তৃক রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক লেখা চারটিখানি কথা নয়। এই কাজটি শুধু অসম্ভব প্রতিভাধর ম্যাক্সওয়েলের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এর পরও তিনি একটির পর একটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে থাকেন। যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর তখন তিনি আরও একটি গবেষণাপত্র লেখেন। এই গবেষণাপত্রটিতে তিনি দেখিয়েছিলেন পাকানো বক্ররেখা এবং সংকোচনশীল নিরেট বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্যের বিষয়টি। তিনি এই গবেষণাপত্রটিও রয়েল সোসাইটিতে জামা দিয়েছিলেন। তিনি শুধু গণিত নিয়েই গবেষণা করেননি। তিনি মহাকাশ বিজ্ঞানের উপরও গবেষণা করেছিলেন। শনি গ্রহের বলয়ের রহস্যময়তার উপর তিনি একটি মূল্যবান গবেষণাপত্র রচনা করেন। তাঁর অন্যান্য গবেষণাপত্রের মত এই গবেষণাপত্রটিও ছিল একটি মৌলিক গবেষণা। এই প্রবন্ধের জন্য তিনি খ্যাতি পেতে শুরু করেন এবং এটির জন্য তিনি অ্যাডাম পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। তখনকার একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন নিকল। তিনি স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ছিলেন। এক সময় ম্যাক্সওয়েল নিকলের সংস্পর্শে আসেন। নিকল ম্যাক্সওয়েলের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন আদর্শ। নিকলের সংস্পর্শে এসে তাঁর প্রতিভার সত্যিকার বিকাশ ঘটে। এ সময় তিনি কাঁচ নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে উৎসাহী হন। তিনি কাঁচ নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। এই কাঁচ নিয়ে গবেষণার ফলাফলগুলো তাকে পরবর্তীতে অনেক সাহায্য করে। এসময়ই তিনি আলোর বর্ণালী নিয়ে অনেক মূল্যবান তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। নিকল এবং ম্যাক্সওয়েল যৌথ ভাবে প্রাণীর বর্ণান্ধতার উপর একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন। এর পরবর্তীতে তিনি তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার তড়িৎচৌম্বকীয় তত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই কাজের জন্য তাঁর মূল অনুপ্রেরণা দাতা হচ্ছেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। ফ্যারেডে আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন যে আলো প্রকৃতিগত ভাবেই তড়িৎচৌম্বকীয়। কিন্তু ফ্যারাডের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল কম। তাই তিনি এ বিষয়ে বেশি দূর কাজ করতে পারেন নি। আলোর তড়িৎচৌম্বকীয় প্রকৃতি জানার জন্য তিনি অনেক গবেষণা পরিচালনা করেন। তাঁর গবেষণার ফলে প্রাপ্ত উপাত্তগুলো নিয়ে তিনি একটি গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করান। পরে তিনি তাঁর প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এটি ছিল তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধ “ডাইনামিক্যাল থিওরি অব ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড", এর কিছুদিন পর তিনি এই নিবন্ধটিকে পূর্নাঙ্গ রূপ দানের জন্য কাজ করতে থাকেন। আট বছরের মাথায় তিনি একটি পূর্নাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটির নাম “ট্রিটিস অন ইলেকট্রিসিটি এন্ড ম্যাগনেটিজম”। তিনি ১৮৫৪ সালে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে। লন্ডনের কিংস কলেজে তিনি ১৮৬০ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর অধ্যাপনা করেন। এর পরে তিনি ১৯৭০ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানেই অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই মহান বিজ্ঞানী ১৮৭৯ সালের ৫ নভেম্বর মৃত্যু বরন করেন।