ছবি সংগৃহীত

উৎসবে-ঐতিহ্যে আলপনা

nusrat jahan champ
লেখক
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০১৩, ০৯:৪৮
আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৩, ০৯:৪৮

বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলে আলপনা একটি অতি পরিচিত নাম। রং ও রেখার সমন্বয়ে জন্ম নেয় নানান ধরনের আলপনা। বিয়ে, গায়ে হলুদ, বসন্তবরণ ও নববর্ষের উত্‍সব যেন অপূর্ণ থেকে যায় আলপনা ছাড়া। লৌকিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাঙালির মনের সম্ভবত বিশুদ্ধতম প্রতিফলন ঘটেছে আলপনায়। এই শিল্প প্রাচীনতমও বটে! কারণ প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় পাওয়া বিভিন্ন পোড়ামাটির টেরাকোটায় আলপনার ভাব দেখা যায়। বিশেষ করে, বর্তমানকালের আলপনায় ব্যবহৃত কোনো কোনো নকশার সাথে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার সময়ের নকশার সাথে মিল রয়েছে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় প্রাপ্ত অসংখ্য মাটির খোলায়, ছোট ভাস্কর্যের গায়ে আলপনা দেখা যায়, যা নিশ্চিত করে সে সময়েও আলপনার প্রচলিত ছিল।

পণ্ডিতব্যক্তিদের ধারণায় প্রাগৈতিহাসিক কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে অস্ট্রিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল, আলপনা তারই ফল। এবং এই ধারা সুদূর মেক্সিকো পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। তাই বলা যায়, প্রাগৈতিহাসিক ও আধুনিক মানুষের লৌকিক শিল্প অভিব্যক্তির মধ্যে আলপনা এক অভিনব মিলনসেতু! আলপনার রং হিসেবে একেক জায়গায় একেক রকমের রং তৈরি ও ব্যবহার হয়। আতপ চালের গুঁড়া, সিঁদুর, হলুদের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, পাতিলের কালি, কাঁচা গোবর গোলা পানি, মেহেদী বাটা রং ইত্যাদি দিয়ে সনাতন আলপনা তৈরি করা হতো এবং এখনো হয়। বর্তমানে আলপনার করার জন্য নানা ধরনের কৃত্রিম রং কিনতে পাওয়া যায়। ঝামেলাহীন বলে এসব রঙেই আলপনা আঁকা হয় বেশি। বিভিন্ন ব্রত ও লোকাচারের সাথে আলপনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সুদূর অতীত থেকে ব্রতানুষ্ঠানে অংকিত হয়েই আলপনার বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকালের অপরিণত সমাজের লোকরা যেসব কামনা-বাসনা পূরণের জন্য দেবতাদের দ্বারস্থ হতেন, সেসবের প্রতিচ্ছবি অংকিত হয়েছে আলপনায়। প্রার্থিত বিষয়ের মনগড়া প্রতীক চিহ্নগুলো মনোজ্ঞ রূপায়নই হলো আলপনা। কিন্তু নিছক বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যেই যে আলপনাগুলো আঁকা হতো, তা নয়। কারণ, অভীষ্ট বস্তুর চিত্র ছাড়াও নানা রকমের গাছ, পদ্ম, ফুল, পাতা, নদ-নদী, পল্লীজীবনের নানা দৃশ্য, পশুপাখি, মাছ, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আসবাবপত্র, অলংকার, কল্পনাভিত্তিক চালতালতা, কলমিলতা, কলকা, খুন্তিলতা, শঙ্খলতা ইত্যাদিও আলপনায় ব্যবহৃত হয়েছে।
বিভিন্ন ব্রত অনুষ্ঠান, মাঙ্গলিক কর্ম বা পূজা-পার্বণের আলপনা পরবর্তীতে স্থান করে নেয় সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পূজাঅর্চনায়, মেয়েলি ব্রতে, বিয়ে, গায়ে হলুদে, সন্তানের শুভকামনার অনুষ্ঠানে বাড়ির মেঝেতে, দেয়ালে, ডালা, কুলায়, পিঁড়িতে, ঘটে ও সরায় আলপনা আঁকা হয়। মুসলিম সম্প্রদায় মূলত বিয়ে, গায়ে হলুদে ও সন্তানের মুখে ভাতের অনুষ্ঠানে আলপনা করে থাকে। আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, চাকমা, মগরা বাসগৃহের দেয়ালে ছবি আঁকে। বিশেষ করে সাঁওতালরা বাড়ির দেয়ালে এক ধরনের ছবি আঁকে সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, এগুলোও আলপনার পর্যায়ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে তাঁর বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে, আলোচনা সভায়, প্রার্থনা অনুষ্ঠানে আলপনা করার রীতি চালু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথই আধুনিক জনজীবনে আলপনার প্রচলন করেন। দৃষ্টি নান্দনিকতার গুণে আলপনা নগরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে। তাই শুধু বিয়ে, পূজা বা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নয়, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও ২১শে ফেব্রুয়ারির মতো জাতীয় উত্‍সবে রাজপথে আলপনা করা হয়। শুধু উত্‍সব নয়, আলপনা হতে পারে প্রতিবাদের ভাষাও! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলপনা অংকন প্রমাণ করে দিয়েছে সেটাও।