ছবি সংগৃহীত

আমার দিন: ফুল বিক্রি করে স্কুল হয় না

জাকারিয়া স্বপন
সম্পাদক, প্রিয়
প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৭:২৪
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৭:২৪

এক.

গত সপ্তাহেও বাচ্চাগুলো রাস্তায় গাড়ি থামাল। গায়ে হলুদ রঙের টি-শার্ট, হাতে ফুল। টি-শার্টের লেখা থেকে বুঝতে পারলাম, তারা বাংলাদেশের সবার জন্য মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায়। ফুল বিক্রি করে টাকা যোগাড় করছে স্বেচ্ছাসেবকরা। গাড়ি জানালার কাঁচ নামিয়ে কেউ টাকা দিয়ে সেই ফুল কিনছে। দূরে একজনের কাছে রশিদ বই। কেউ সেই রশিদ নিচ্ছে, কারো হয়তো সেটা নেয়ার মতো সময়ও নেই। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে একদল ছেলেমেয়ে এভাবেই ফুল বিক্রি করে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার ব্রত নিয়েছে। এটা যে একটি ট্রাফিক সিগনালে করা হচ্ছে তা নয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সিগনালে একই সাথে ফুল বিক্রি করছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে মাঝে মাঝেই এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার একই দৃশ্য আমি দেখেছি।

এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবা; ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ভলেন্টিয়ারিং। বিনা পারিশ্রমিকে সমাজের কোনো একটি কাজ করে দেওয়া। যে কোনো মাপেই স্বেচ্ছাসেবা একটি মহৎ কাজ। বাংলায় যদিও একটি প্রবাদ আছে যে “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো”, তবে কিছু মানুষ এই সমাজে থাকে যারা এই কাজগুলো ঠিকই করে থাকেন। সময়ের সাথে সাথে এখন স্বেচ্ছাসেবার ধরন অনেক পাল্টে গেছে। আমরা আশা করছি না সবাই বনের মোষ তাড়াবে, তবে “গিভিং ব্যাক” কনসেপ্টটা সমাজে থাকাটা জরুরি। খালি সারাক্ষণ আমি নিব, আর কিছুই ফেরত দিব না- এটা খুবই স্বার্থপর চিন্তাভাবনা। একটি সমাজ যদি শুধুই স্বার্থপর হয়ে ওঠে, তখন সে তার ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে, তাতে কোনোও সন্দেহ নেই। বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, “নিজের বোচকা সাবধান, অন্যের বোচকা ঘরে আন।” ছলচাতুরি করে সম্ভব না হলে শক্তি প্রয়োগ করে, সেটা না হলে কারো জীবন নাশ করে দিয়ে হলেও অন্যের সম্পদকে নিজের করে নেওয়ার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, এবং সেটাকে আমরা সবাই যেভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি, তার ভেতরে যদি কেউ স্বেচ্ছাসেবা নিয়ে কাজ করে তাকে তো মাদার তেরাসার মতো সন্মান জানানো উচিৎ। স্বেচ্ছাসেবাকে আমি মনেপ্রাণে সমর্থন করি। তবে বাচ্চাদের রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ফুল বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করাকে আমি সমর্থন করি না।  

ঢাকার রাস্তায় যারা ফুল বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করছে, তারা সবাই ধনী ঘরের সন্তান। তারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে, যাদের স্কুলের বেতন খুব কম করে হলেও মাসিক ১০ হাজার টাকা এবং বছরে লক্ষাধিক টাকা। কারো কারো আরো অনেক বেশি। এই ছেলেমেয়েদের একজনের পেছনে বছরে শুধু শিক্ষা বাবদ যে টাকা খরচ হয়, সেটা দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে পুরো একটি স্কুল চলতে পারে। স্বেচ্ছাসেবা করতে হয় এক ধরনের বিশ্বাস থেকে। তারা যদি সত্যিই বিশ্বাস করে থাকে যে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে তারা সাহায্য করতে পারে, তাহলে তাদের প্রথম কাজটি হবে পরিবারকে বলে গ্রামের স্কুলগুলোকে সাহায্য করা (কিংবা যে স্কুলগুলোকে তারা সাহায্যের জন্য টাকা তুলছে সেগুলোকে পরিচালনা করা)। যখন এই কাজটি করার পরেও তাদের বাড়তি টাকার প্রয়োজন হবে, তখন রাস্তায় নামার কথা ভাবা যেতে পারে। এবং তখনও সেই বিশ্বাসকে ধরে রাখতে হবে।

দুই.

ঢাকা শহরের ট্রাফিক লাইটে ফুল বিক্রি করে কত টাকা ওঠে? আমি যেই সিগনালগুলোতে লক্ষ্য করেছি, সেখানে তাদের হাতে ৫০০ ফুলও ছিল না। ধরে নেই সারাদিনে একটি দল ৫০০ ফুল বিক্রি করতে পারবে। একটি ফুলের জন্য গড়ে মানুষ ৫০ টাকা করে দান করতে পারে। (এখানে ফুল বিক্রিটা মূখ্য নয়, এটা মূলত অনুদান চাওয়া)। তাহলে একটি ট্রাফিক সিগনালে উঠতে পারে ২৫,০০০ টাকা। একটি দলে দেখে মনে হলো ২৫ জনের মতো কাজ করছেন। তাহলে এই ২৫ জনের জন্য প্রতিষ্ঠানের খরচ হলো ১২,৫০০ টাকা (তাদের টি-শার্ট, দুপুরের খাওয়া, যাতায়াত ইত্যাদি মিলে গড়ে ৫০০ টাকা হারে)। অর্থাৎ অর্ধেকই চলে গেছে টাকা তুলতে। এই হিসাবে তারা সারাদিন কয়েক লক্ষ টাকার বেশি তুলতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। অথচ এদের অনেকেরই পরিবারের সামর্থ রয়েছে এর চে’ অনেক বেশি অনুদান দেয়ার। তারা তাদের পরিবারকে কেন প্রথমে কনভিন্স করতে পারছেন না?

এর বিপক্ষে কঠিন যুক্তি হলো- না, পরিবারগুলো চাইছে তাদের সন্তানেরা স্বেচ্ছাসেবার সাথে যুক্ত হোক, স্বেচ্ছাসেবা শিখুক; তাহলে ভবিষ্যতে চোর-ডাকাত না হয়ে কিছু হয়তো সমাজে ফেরত দিবে। সমাজকে অনুভব করতে শিখবে। বাংলাদেশকে চিনতে পারবে। পাশাপাশি অন্যকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। নিজের সন্তানের সঠিক ট্রেনিং-এর জন্য মা-বাবা হিসেবে এমনটা তো কেউ ভাবতেই পারেন।

রাস্তায় গাড়ির আরোহীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হলো এই পৃথিবীর সবচে’ নিম্নমানের স্বেচ্ছাসেবা। জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতি সংকটে না পড়লে এমন কাজে নামে না। ধরুন বন্যা, ভূমিকম্প কিংবা আগুনে হাজার হাজার ঘরবাড়ি এবং জীবন সংকটে পড়েছে। সেই সংকটে জরুরি ভিত্তিতে সাহায্যের জন্য মানুষ রাস্তায় নামে। এর বাইরে পরিকল্পতিভাবে কাউকে সাহায্য করতে হলে, কোনোও সংগঠন যদি রাস্তা থেকে টাকা তোলার পরিকল্পনা করে থাকে- এর চেয়ে নিচুমানের পরিকল্পনা আর দ্বিতীয়টি হতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। হয়তো প্রচার, নয়তো টাকাটা নয়ছয় করা।

স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবা শেখানোর জন্য টাকা তুলতে হবে কেন? একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখেছেন রাস্তায় আর কারা গাড়ি থামিয়ে টাকা চায়? ঢাকা শহরের ফকির চক্র (যারা একটা মাফিয়া দলের অংশ), এলাকার ক্লাবগুলো, মসজিদ/মাদ্রাসার লোকজন, অসুস্থ্য বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য বাক্স নিয়ে শত শত মানুষ ট্রাফিক লাইটে জ্যাম করে থাকে। তার ভেতর নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে এই ফুল বিক্রি।

বাংলাদেশে কি স্বেচ্ছাসেবার আইডিয়ার কমতি রয়েছে? যে কোনোও মানুষকে খারাপ করার জন্য সবচে ভালো যন্ত্র হলো টাকা-পয়সা। আপনি একটি ভালো ছাত্রকে খারাপ বানাতে চান, তার হাতে প্রতিদিন কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে দেন। এবং সে যদি বুঝতে পারে, এ টাকাটার হিসাব-নিকাশে একটু ঝামেলা রয়েছে- কোমল সেই ব্রেইন বিপথে যাবেই। যারা গাড়ি থেকে টাকা তুলছে, তারা সবাই রশিদ নিচ্ছে না, কিংবা তারা দিতেও পারছেন না। ফলে কেউ চাইলেই এখানে কিছু টাকা এদিক-সেদিক করে ফেলতে পারে। আমরা এমন স্বেচ্ছাসেবায় কেন যাব যেখানে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মাথায় ভিন্ন চিন্তার জন্ম দিতে পারে? 

স্বেচ্ছাসেবা করতে ইচ্ছে করে? তাহলে শুক্রবারে ঢাকা শহরের ময়লা পরিষ্কার করো, নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার করো, স্কুলে গিয়ে কিছু একটা পড়াও, লেকচার সিরিজ করো, কম্পিউটারে ভালো টিউটোরিয়াল বানিয়ে ছাড়ো, বাসার কাজের বুয়ার ছেলেমেয়েকে পড়াও কিংবা কোথাও গিয়ে শারীরিক শ্রম দাও। টাকা তোলার মতো খারাপ বুদ্ধি তোমাদের মাথায় কে দিয়েছে? হাতে সময় থাকলে ঢাকার বাইরে যাও। সেখানে গিয়ে যেই জমিতে ফুলের চাষ হয় সেখানে গিয়ে গায়ে-গতরে এক বেলা পরিশ্রম করে সেই কৃষককে সাহায্য করো। ঢাকা শহরে অনেক পার্ক আছে যেগুলোর ভালো পরিচর্যা হয় না। সেই গাছগুলোকে যত্ন করো, পানি দাও, ময়লা পরিষ্কার করে দাও। সেখানে অনেক মানুষ বসেন। তাদের পাশেই কেউ হয়তো প্রাকৃতিক কাজটি করে রেখেছে। সেটাকে বসার যোগ্য করো। ঢাকা শহরে অনেকগুলো লেক মরতে বসেছে। সেখানে ময়লার ঢিবি। সেগুলোকে পরিষ্কার করো। ঢাকা শহরের মেয়রদেরকে বলো, তাদের কাছে কাজের অভাব নাই, আইডিয়ারও অভাব নাই। দয়া করে আর টাকা তোলার মতো বাজে কাজ করতে এসো না। আর গরীবদের নাম ভাঙ্গিয়ে তো আরো না।

যখন আমরা কোনোও সংকটে পড়ব, তখন হাত পাততে রাস্তায় নামব। ততদিন রাস্তাটা পরিষ্কার রাখো। উল্টো ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করছ কেন?

 

তিন.

ব্র্যাক (বাংলাদেশ রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি) হলো এই পৃথিবীর সবচে’ বড় এনজিও (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা)। “তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতায়নের অঙ্গীকার নিয়ে এই সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে। জনগোষ্ঠীভিত্তিক ব্র্যাকের বিভিন্ন উদ্ভাবনা যথা- ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, আইন-সহায়তা, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ, জীবিকা সংস্থান, অতিদরিদ্রদেরকে সম্পদ হস্তান্তর, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজের অধিকারবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছে। ১৯৭২ সালে ব্র্যাক তার যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এর ১ লক্ষ ২০ হাজার কর্মী বিশ্বব্যাপী ১১টি দেশে ১৩৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনসংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।” [সূত্র: ব্র্যাক ওয়েবসাইট]

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ব্র্যাককে নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু আমি করি না; বরং লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যায়। ব্র্যাক-সহ বাংলাদেশের সকল এনজিওগুলোর মূল ভিত্তি হলো দারিদ্র। “আমরা গরীব” -এই কথাটা আমরা ধনীদের কাছে নিত্যদিন বিক্রি করি। যে কারণে ইংল্যান্ডের রানি যখন আমাদের পুরস্কার দেন, আমরা মোমের মতো গলে যাই। ফিনল্যান্ডের রানি যখন আমাদের দেশে আসেন, আমাদের মাটি ধন্য হয়ে যায়। অথচ একটি বারের জন্য কেউ বলেন না, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি বড় হয়, আমরা ততো বেশি দরিদ্র হই। এটা সরাসরি ইনভার্সলি প্রপোর্শনাল। দিস ইজ দি সিম্বল অফ প্রভার্টি। ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যত বড় হয়, সরকার ততো ব্যর্থ হয়ে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মানুষ দরিদ্রকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো যত ছোট হতে থাকবে, আমরা ততো ধনী হতে থাকব। কারণ তখন তাদের কার্যক্রম কম প্রয়োজন হবে। উন্নত বিশ্বে তো ব্র্যাকের জন্ম হয়নি; উন্নত বিশ্বের আর্থিক সাহায্যে ব্র্যাকের জন্ম হয়েছে।

অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, আমি সরাসরি ব্র্যাকের বিরুদ্ধে লিখতে বসেছি। বিষয়টি তা নয়। ব্র্যাক যেহেতু বিশ্বের সবচে’ বড় এনজিও (এবং সেই মাপে আমরা সবচে’ দরিদ্র রাষ্ট্র), তাই ব্র্যাকের নাম এসেছে। এখানে যত বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সবার কার্যক্রমকেই বলছি। আমি তাদের কাজের সমালোচনা করার জন্য লিখতে বসিনি। আমি বলতে চাইছি, রাষ্ট্রের ততোটা উন্নতি হয়নি বলেই তো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন রয়েছে, এবং তারা আরো বড় হচ্ছেন। বাংলাদেশ যখন পুরোপুরি একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে, তখন কিন্তু আর এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ততোটা প্রয়োজন হবে না। তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়বেন।

আমি মনে করি, ব্র্যাকের সবচে’ বড় সফলতা হবে সেদিন, যেদিন তারা এই বিশাল প্রতিষ্ঠানটিকে ডিজলভ (বন্ধ) করে দিতে পারবে। উল্টো অর্থে বাংলাদেশ এমন একটি উন্নত দেশে পরিণত হলো, যেখানে কাউকে দারিদ্রকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করতে হবে না। এটা অনেকটা ডবল-এডজ সোর্ড (যে তরবারী দু'দিকেই কাটে)। ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশ থেকে দারিদ্রকে দূর করতে পারে, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য বিশাল একটি অর্জন; এবং তখন তাদেরকেও প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে হবে। এই বিশাল সিদ্ধান্তটি তারা নিতে পারবেন কি-না, কিংবা তাদের রোডম্যাপে কবে সেটা রয়েছে, তা জানতে খুব ইচ্ছে করে।

চার.

বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষের উপর শিশু-কিশোররা স্কুলে লেখাপড়া করে। এই বিশাল গোষ্ঠিকে সঠিকভাবে লেখাপড়া করানোটা খুবই কঠিন একটি বিষয়। মুখে বললাম, আর কাজটি হয়ে গেল- তা কিন্তু নয়। এই পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যাও এতো বেশি নয়। সেই হিসাবে, এই কঠিন বিষয়টি নিয়ে যারাই কাজ করতে যাবেন, তাদের হিমশিম খেতে হবে বৈকি।

বাংলাদেশের লেখাপড়ার বড় ক্ষতি হয়েছে দু'টি ক্ষেত্রে। প্রথমত, আমরা শিক্ষকদেরকে যথেষ্ঠ সুযোগ সুবিধা দিতে পারিনি। শিক্ষকদের সুবিধার কথা এলেই আমাদের দেশ গরীব, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা, এই পেশায় না খেয়েই থাকা যায়, এই মহৎ পেশায় আবার টাকা-পয়সা কেন ইত্যাদি বিষয়গুলো চলে আসে। এবং তারা একটু বেশি কথা বললেই, কামানের গরম পানি খেতে হয়। আমরা করুণা করে সেবাই প্রাইমারি শিক্ষকদের জন্য মায়া করি; নিজের শিক্ষককে পা ছুঁয়ে ছালাম করি। কিন্তু তার জীবন যে আর চলছে না, তা আমরা কেউ দেখি না। কিন্তু আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, আমাদের শিশুরা সুন্দর নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে। প্রহসন আর কাকে বলে! কিন্তু বাংলাদেশে আরো অনেক মহৎ পেশা আছে, যেগুলোতে এই বিষয়গুলো তো আসেই না, বরং সরকার যেমন আরো তেল ঢালেন, তারা নিজেরাও আরো বেশি সুবিধা নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত পায়তারায় থাকেন। শিক্ষকরা সেটা পারেন না। কেউ কেউ টিউশনি করেন। তাতেও অনেক কথা শুনতে হয়। তাদের তো আর চুরি করার উপায় নেই। ফলে ভালো শিক্ষককে আমরা এই পথে আর আনতে পারিনি। মফস্বলের কিছু শিক্ষকদের সাথে মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়। তাদের মান এবং জ্ঞান দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে।

দ্বিতীয় যে খারাপ কাজটি হয়েছে তাহলো পরীক্ষার ফলাফল। এতো বেশি ছাত্রছাত্রী গোল্ডেন-এ পেতে শুরু করেছে যে, কোনটা যে ভালো তার আর বুঝার উপায় থাকল না। আর যদি বলেন যে, এই গোল্ডেন-এ পাওয়া সবাই সোনার টুকরা ছাত্রছাত্রী, তাহলে কাল থেকেই আমার লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হবে। এরা তো মনে করছে, গোল্ডেন-এ পেয়ে এই দেশকে ধন্য করে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বুঝার উপায় নেই, পৃথিবীর মান থেকে তারা কতটা দূরে অবস্থান করছে। আমি কাউকে চাকরি দেওয়ার আগে প্রথমেই তার স্কুল এবং কলেজটি দেখি এবং তখনকার ফলাফল দেখি। তারপর দেখি কোন বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ, একটি স্কুল এবং কলেজই একজন ছাত্রছাত্রীর ভিত্তি তৈরির আসল জায়গা। এখন আর আপনি ওই ফলাফল দেখে কিছুই বলতে পারবেন না; একদল মূর্খ মানুষ আপনার সামনে বসে আছে। তাদেরকে আবার পরীক্ষা নিয়ে বুঝতে হচ্ছে, তার যোগ্যতাটা কেমন। আগে একটা পিরামিড ছিল, যেখান থেকে আপনি বলতে পারতেন কারা উপরের দিকে, আর কারা মাঝারি। এখন কোনোও পিরামিড নাই। সবাই সমান; গাহি সাম্যের গান।

শিক্ষা ব্যবস্থার যা বারোটা বাজানোর সেটা বাজিয়ে এখন ছুটির ঘণ্টা বাজাটা বাকি আছে। এই যখন অবস্থা, সেখানে এনজিওগুলো তো নতুন আরেকটি কার্যক্রম খুলে বসবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো তাদের কার্যক্রমকে বড় করার জন্যই, বিদেশিদের কাছে হাত পাতার জন্যই এই ব্যবস্থা করেছি। আমরা মনে মনে সবাই গরীব থাকতে চাই। (কানাডায় কিছু বাঙালি আছেন যারা ইচ্ছে করেই কাগজ-কলমে গরীব থাকেন। তখন সরকার থেকে ভাতা পান। চাকরী করলে ট্যাক্স দেওয়ার পর যা হাতে থাকে, তার চেয়ে চাকরি না করে সরকারি ভাতা নিয়ে পাশাপাশি নগদে কোথাও কাজ করলে হাতে বেশি আসে। বোকা কানাডা সরকার!) বাংলাদেশটাকে গরীব রাখতে না পারলে, সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে তো হলো না! আমাদের এমন সব ফন্দি করতে হবে যেন দেশের মানুষ গরীব থাকে, অশিক্ষিত থাকে- তাতে সাদা চামড়াদের কাছে হাত পাততে সুবিধা। আমাদের হাত সবসময় গ্রহীতার হাত হিসেবে নিচেই থাকে। আমাদের হাত কখনই উপরে ওঠে আসে না। কারণ আমরা কাউকে কিছু দিতে শিখিনি। হাত পাতাতেই আমাদের আনন্দ।

 

পাঁচ.

আমাদের হাত পাততে হয় কেন? আমাদেরকে আমেরিকার ধনী বিল গেটসের কাছে হাত পাততে হয় কেন? আমাদের দেশে কি বিল গেটসের মতো ধনী মানুষ নেই? বাংলাদেশে কি এন্ড্রু কার্নেগী, ওয়ারেন বাফেট, জর্জ সোরোস, জর্জ কাইজার, মার্ক জাকারবার্গ, ওয়ালটন পরিবার, মাইকেল ব্লুমবার্গ, পল এলেনের মতো মানুষ নেই। তাদের মতো এত সম্পদ হয়তো এদের নেই, কিন্তু বাংলাদেশের সাপেক্ষে তুলনামূলক সম্পদ যে আছে, তাতে কি সন্দেহ আছে? কিন্তু কই, তারা তো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কোনোও পদক্ষেপ নেন না। গ্রামীণফোনের মতো কর্পোরেটগুলো তাদের নিজেদের নামের জন্য টিভিতে দেখায় সুদূর বান্দরবনে একটি স্কুলকে তারা সাহায্য করে। সাহায্য করে ১ টাকা আর সেটা প্রচার করতে ব্যয় করে ১ লক্ষ টাকা। শিক্ষার প্রতি এটাই তো আমাদের কমিটমেন্ট! যে কারণে বিল গেটসের অনুদানের টাকা দিয়ে ব্র্যাক-এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়!

অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে এতো বেশি ধনীর সংখ্যা পাওয়া যাবে, যারা কয়েক হাজার কোটি টাকার উপর ধারণ করে আছেন। কই, কাউকে তো দেখি না, দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কিছু করতে! তারা যেটা করেন, তাহলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি কলেজ বানিয়ে তার জন্য বিশাল বিলবোর্ড প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের রাস্তায় লাগিয়ে রাখেন। মূল উদ্দেশ্য, প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা।

অপরদিকে বর্তমানের শিক্ষা মন্ত্রী আছেন সংখ্যা বাড়িয়ে বাহবা পেতে, আর তার সচিব আছেন পরবর্তীতে মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ নিয়ে। তিনি যা কিছুই করেন, চমক দেখানো জন্য করেন; ভোটের জন্য করেন। মূল সমস্যাটা সমাধান করার জন্য কিছুই করেন না। মাঝখান দিয়ে সরকারের অনেকগুলো টাকা নষ্ট হয়, নিজের প্রচার হয়।

শিক্ষা হলো একটি সুদূর প্রসারী বিনিয়োগ। এতো দ্রুত ফল পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের যে এখনই ফলাফল লাগবে! তাই কেউ ফুল বিক্রি করে স্কুল চালান, কেউ চালান বিল গেটসের টাকায়; কেউবা বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্টের পয়সায়। আমি কেবল আশায় আশায় থাকি, কবে এই দেশের মানুষ নিজেদের পয়সায় নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবে। বলতে কি পারো নাদের আলী?

 

৪ ডিসেম্বর ২০১৫
লেখক: তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম
ই-মেইল:: [email protected]

লেখাটি একই সাথে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে।