টানাটানিতে চলছে নিহতদের সংসার
বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে বাবা মারা গেছে। মৃত্যু কি বোঝার বয়স এখনো হয়ে উঠেনি আড়াই বছর বয়সী হৃদয়ানের। বাবা মো. ফজলে রাব্বির খুব আদরের সন্তান ছিল হৃদয়ান। রাব্বির স্বপ্ন ছিল ছেলেকে কোরআনে হাফেজ বানানোর। পাশাপাশি নিজের আয়ের টাকা দিয়ে বাবা-মাকে হজে পাঠানোর। সুখ-শান্তি, হাসি-খুশি লেগেই থাকত তার পরিবারে। কিন্তু এখন? সব আনন্দই উবে গেছে। নিরানন্দ ভর করেছে মনে। সংসারে। মিইয়ে গেছে রাব্বির পরিবারের সব সুখ। মৃত্যুর ২২দিন পরে পরিবারের সবাই নিজেদের মত করে মনকে শান্তনা দিয়েছেন। কিন্তু আড়াই বছর বয়সি এই অবুঝ শিশু এখনও মোবাইল ফোনে তার বাবাকে খোঁজে বেড়াচ্ছে। বারবার তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বাবাকে দেখার জন্য তার মায়ের কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। ছবি দেখে দেখেই বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বাবা তুমি কবে আসবে বাড়িতে?পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ফজলে রাব্বি। তার আয়েই সংসারের বড় বড় খরচ চলত। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তার মৃত্যুতে পরিবার বেশ টানাটানির মধ্যে চলছে। নারায়নগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার ভুইগড় এলাকায় তাদের বাড়ি। বাবা জহিরুল হক সেলিম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরি করেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাব্বি ছিল মেঝ। ছোট ভাই রিফাতও লেখাপড়ার খরচ চালাতে ছোট একটি চাকরি করেন। তার বড় বোন শাম্মি আক্তার গতকাল মানবজমিনকে বলেন, বাবার অনেক বয়স হয়েছে। তার ওপর আবার অসুস্থ। ছোট একটি চাকরি করেন। কিন্তু রাব্বি মারা যাওয়ার পর শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক ভেঙ্গে গেছেন। কর্মস্থলে ঠিকমত আসা যাওয়া করতে পারছেন না। ছোট ভাইও অসুস্থ। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যাথা। ভারি কোন কাজকর্ম করতে পারে না। সংসারে ৭/৮ জনের সংসার চালাতে বাবা হিমশিম খাচ্ছেন। রাব্বিকে হারিয়ে আমরা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছি। এখনও টানাটানি করে যতটুকু চলছে আগামীতে কি হবে জানিনা। শাম্মি বলেন, সরকারিভাবে যদি আমাদের কোন সাহায্য-সহযোগীতা করা হয় তবে যেন আমার ছোট ভাইকে একটা সরকারি চাকরি দেয়া হয়। তাহলে কিছুটা হলেও আমাদের পরিবার নিশ্চিন্ত হবে। ফজলে রাব্বি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ইউরো ফ্রেড কোম্পানিতে চাকরি করতেন। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন সেখান থেকে তাকে কোন আর্থিক সহযোগিতা করা হয়নি বলে তার পরিবার জানিয়েছে। রাব্বীর স্ত্রী সাবিয়া আক্তার মানবজমিনকে বলেন, সংসার নিয়ে আমার স্বামীর অনেক স্বপ্ন ছিল। ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো, মা-বাবাকে হজে পাঠানো। আজ তিনি বেচে নাই। মনে হচ্ছে এই দায়িত্বগুলো যেন আমার ওপরেই এসে পড়েছে। কিন্তু আমি কোন চাকরি করি না। কিভাবে এই দায়িত্ব পালন করব। তিনি বলেন আমার ছেলে সারাক্ষণ তার বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। মৃত্যুর পর রাব্বির কিছু ছবি তোলা হয়েছিল মোবাইল ফোনে। ঝলসে যাওয়া ছবি দেখে বলে সে জানতে চায় তার বাবার পায়ে কি হয়েছে। ফজলে রাব্বির পরিবারের মতই টানাটানির মধ্যে আছেন মো. ইফতেহার হোসেন মিঠুর পরিবারের সদস্যরা। ৩৭ বছর বয়সি মিঠু ছিলেন বনানীর এফআর টাওয়ারের ফ্লুগাল লজিস্টিক কোম্পানির সিনিয়র হিসাব কর্মকর্তা। বনানীর অগ্নিকান্ডে তিনিও প্রাণ হারিয়েছেন। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চর বানিয়া পাড়ায়। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা কৃষি কাজ করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই স্বল্প পুঁজির কাপড়ের ব্যবসায়ী আরেক ভাই মিঠুর সঙ্গে ঢাকার কচু ক্ষেতে থেকে লেখাপড়া করত। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আরো আগে। এছাড়া স্ত্রী আয়শা আক্তার আশা ও আবির হোসেন মুগ্ধ নামের আড়াই বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে। মিঠুর ভাই ইফতেখারুল আলম গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আমার বাবা দুইবার স্ট্রোক করেছেন। কৃষি কাজের পাশপাশি বাবা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। অসুস্থ হওয়ার পর আমিই এই ব্যবসার দেখাশুনা করছি। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমাদের সংসারে বেশ টানাটানি শুরু হয়েছে। সংসার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, শুধু তাই নয় ভাইয়ের মৃত্যুতে ভাবীও বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন। তার সন্তান আবির হোসেন মুগ্ধ তার বাবার কথা মনে হলে বারবার মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করে। মিঠুর স্ত্রী আয়শা আক্তার আশা মানবজমিনকে বলেন, স্বামী হারিয়ে এখন আমি অনেকটা অনিশ্চয়তায় আছি। স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এসে উঠেছি। একমাত্র সন্তান আবিরকে নিয়েই এখন আমার ভরসা। স্বামীর কর্মস্থল থেকে তার এক মাসের বেতন আমাকে দেয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে আবার তারা যোগাযোগ করবে। বনানীর অগ্নিকান্ডে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন পাবনার আতাইকুলার গাঙ্গহাটির আইয়ুব আলী। কৃষি কাজ করে ছেলে আমির হোসেন রাব্বিকে লেখাপড়া করিয়েছেন। স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। দুই বোনের বিয়ে হওয়াতে তার মা এখন একা হয়ে গেছেন। তাই ভালো মেয়ে দেখে তার বিয়ে দেয়া হবে। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। ছয়মাস হয় রাব্বি বনানীর ইসিইউ লাইন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। মাঝখানে ছুটিতে এসে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখে গেছে। কিন্তু ২৮শে মার্চ এফআর টাওয়ারের অগ্নিকান্ড সব স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। আগুনে ঝলছে রাব্বির পরিবারের সব স্বপ্ন এখন শুধুই স্বপ্ন। ছেলেকে হারিয়ে তার মা এখন পাগল প্রায়। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তার বাবা কৃষি কাজ গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলের আয়ের টাকা দিয়ে বাকি জীবনটা সুখে শান্তিতে কাটিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে নি।