কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

স্মরণীয় বরণীয় মাহবুব আলী খান

মানবজমিন প্রকাশিত: ০৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

‘দিন যায় মাস যায় সময় কাহারও নয়, বেগে ধায় নাহি রহে স্থির... আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর’মহাকালের তুলনায় মানুষের আয়ুষ্কাল নিতান্তই ক্ষীণ। কবির ভাষায়, এটি হচ্ছে পদ্মপাতার ওপর জমে থাকা এক ফোঁটা পানির মতো। টলমল করতে করতে কখন যে ঝরে যাবে তার কোনো ঠিক নেই।খুব সংক্ষিপ্ত আর ক্ষীণ এই আয়ুষ্কালের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষ সুকৃতি নির্মাণ করেন যার ফলে চিরকাল তাঁরা মানুষের অন্তরে জীবিত থাকেন। তাদের আদর্শ, জীবনধারা মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠে।বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যোগাযোগ উপদেষ্টা, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও সাবেক নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান (এমএ খান) ছিলেন সে রকমই এক মহান পুরুষ। যতদিন জীবিত ছিলেন দেশের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করেছেন। তার দেশপ্রেম, কর্মনিষ্ঠা, দক্ষতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আজও আমাদের অন্তরে শ্রদ্ধা ও সমীহ জাগায়। তিনি আচরণে ছিলেন খুবই অমায়িক। অবসরে প্রচুর পড়াশুনা করতেন। নৌ-বিদ্যা, সমরবিদ্যা তাঁর পেশার অন্তর্গত ছিল। এছাড়াও দর্শন, আইন, সমাজসেবা ও ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল সুগভীর। কর্মজীবনে তাঁর সততা ছিল নিখাদ। তাঁর গুণ, জ্ঞান, বাচনভঙ্গি ও আচরণেই আভিজাত্যের ঝলক উদ্ভাসিত হতো।আজ ৬ই আগস্ট তার ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৪ সালের এই দিনে তিনি আকস্মিক পরলোকগমন করেন। বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল। তাতে হতাহত হয়েছিলেন কয়েকজন। রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান সেখানে পরিদর্শন করতে তেজগাঁও বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সকাল বেলা। দুর্ঘটনার চিত্র দেখে অন্তরে কষ্ট পেয়ে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে চিকিৎসার জন্য সিএমএইচ-এ নিয়ে আসা হয়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।অন্যের দুঃখ-কষ্টে সংবেদনশীল এই মানুষটি সারাজীবন জনকল্যাণে নিবেদিত থাকার চেষ্টা করেছেন। ধানমন্ডি ৫ নং সড়কে তাঁরই প্রণোদনায় তার স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু অনাথ, এতিম, দরিদ্র শিশুদের জন্যে ‘সুরভী’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে শিশুদের রোজ একবেলা খাবারসহ বিনামূল্যে শিক্ষা দেয়া হয়। বই-পুস্তক, পোশাকসহ অন্যান্য উপকরণের খরচও স্কুলটি বহন করে থাকে। শিক্ষা ও সেবার উচ্চতর মানের কারণে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। সারা দেশে সুরভীর শতাধিক শাখা মানবতার সেবায় কাজ করছে।এমএ খান ‘পেট লাভার’ হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তার পোষা প্রিয় বিড়ালটির নাম ছিল ‘পুষি’। মানুষের যেমন যত্ন নিতে হয় তেমনি তিনি পোষা বিড়ালটিরও যত্ন নিতেন। তার খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা থেকে শুরু করে জামা-কাপড় পর্যন্ত বানিয়ে দিতেন। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে হঠাৎ করেই তার সেই আদরের ‘পুষি’ মারা গেল। তিনি অনেক যত্ন করে সুরভী স্কুলের চত্বরেই তাকে সমাধিস্থ করলেন। ‘পুষি’র মৃত্যুতে তিনি এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, ঠায় তিন ঘণ্টা ওই সমাধির পাশে বসে নীরবে রোদন করেছেন। বড় বিচিত্র আর বিস্ময় এই যে, তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগেই এই ঘটনা ঘটেছিল।এই মহৎ-হৃদয় মানুষটির জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩রা নভেম্বর সিলেট জেলার বিরাহীমপুরের এক সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে। তার পিতা আহমেদ আলী খান প্রথম মুসলিম হিসেবে তৎকালীন ভারতে ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার হন। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রিও অর্জন করেন। হায়দ্রাবাদের ‘নিজাম’-এর প্রধান আইন উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।এমএ খানের মাতা ছিলেন জুবাইদা খাতুন। তিনি বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদের কন্যা। মরহুমা জুবাইদা খাতুনের দাদা ছিলেন ব্রিটিশদের থেকে ‘অর্ডার অব এমপায়ার’ (ঙভভরপবৎ ড়ভ ঃযব গড়ংঃ ঊীবপষষবহঃ ঙৎফবৎ ড়ভ ঃযব ইৎরঃরংয ঊসঢ়রৎব-ঙইঊ)  খেতাবপ্রাপ্ত। এমএ খানের চাচা গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ভারতে চতুর্থ মুসলিম হিসেবে আইসিএস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে ব্রিটিশদের থেকে অর্ডার অব এমপায়ার খেতাব পান।এমএ খানের দাদা ছিলেন তৎকালীন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খান বাহাদুর আজদার আলী খান। তিনি বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ও পাটনা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ১৯২৪ সালে সিলেটে নাফিজা বানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ১৯৩০ সালে ম্যাটার্নিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।এমএ খানের পিতার মামা জাস্টিস আমির আলী কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এমএ খানের দাদা খান বাহাদুর আজদার আলী ছিলেন স্যার সৈয়দ আমীর আলীর জামাতা। স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন ইংল্যান্ডের রয়েল প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য এবং ইন্ডিয়ান ভাইসরয়েজ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। স্যার সৈয়দ আলীর বিখ্যাত দু’টি গ্রন্থ হলো- ‘হিস্ট্রি অব সারাসেন’ ও ‘স্পিরিট অব ইসলাম’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী ছিলেন এমএ খানের চাচাতো ভাই। শের-এ সিলেট ও অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী আজমল আলী চৌধুরীও তাঁর চাচাতো ভাই। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে এমএ খান ছোট। সবার বড় বোন সাজেদা বেগম। মেজো ভাই বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সিকেন্দার আলী খান। মরহুম ডা. সেকেন্দার আলী খানের মেয়ে আইরিন খান, যিনি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল।সিলেটরে বিরাহীমপুর, কলকাতা ও পুরান ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে এমএ খানের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়। তিনি কলকাতা ও ঢাকায় শিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত, ধীর ও চিন্তাশীল। কান্তিময় চেহারা, সুঠাম শরীর ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিব্যক্তির কারণে পরিবারের মধ্যমণি ছিলেন। আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেরই প্রিয় ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা করতেন। ব্যাডমিন্টন খেলায় পারদর্শী ছিলেন। খেলা নিয়ে ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদও হতো। পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে সামনের খালি জায়গায় ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট কেটে ভাইবোনরা দিন রাত খেলতেন। ধর্মের প্রতি ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। প্রতিদিন সকালে নামাজ আদায় করে পবিত্র কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। যে কোনো কাজে বের হওয়ার আগে তিনি আল্লাহ্‌কে স্মরণ করতেন।১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধানের পদে উন্নীত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ওই পদে নিয়োজিত ছিলেন। মাঝখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ১৯৭৫ সালের পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা, ১৯৮২ সালের জুলাইয়ে যোগাযোগ উপদেষ্টা ও পরে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি যোগাযোগ উপদেষ্টা থাকাকালে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ওই সময়ে তিনি দিবারাত্র অবিশ্রান্ত কাজ করেছেন। ঢাকা-সিলেট রোডে সুরমা নদীর ওপর লামাকাজী এলাকায় ‘এমএ খান সেতু’ আজও তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। কৃষি বিপ্লবের পরিকল্পনা তাঁর মাথায় ছিল। অকাল মৃত্যুর কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি।ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সহজ, সরল মিশুক ছিলেন। পরিবারের সকলকে নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। বেশ ভোজনরসিকও ছিলেন। গলদা চিংড়ি, ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করতেন। ১৯৬০ সালে তিনি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই কন্যা-শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. জুবাইদা রহমান (ঝুনু)। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশুনা করেছেন। ছোট কন্যা জুবাইদা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেছেন। এরপর তিনি বৃটেনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজির উপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেন। এতে বায়ান্নটি দেশের অংশগ্রহণকারী ডাক্তারদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর সৈয়দ শফিউজ্জামান এমএ খানের জ্যেষ্ঠ জামাতা। তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। আর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এমএ খানের কনিষ্ঠ জামাতা। তারেক রহমান ও জুবাইদা রহমানের কন্যা জায়মা রহমান এমএ খানের নাতনি। তিনি যুক্তরাজ্যে আইন শাস্ত্রে অধ্যয়নরত আছেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও