বিভেদ নয়, বিশ্বাস করি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের রাজনীতিতে

প্রথম আলো খালেদা জিয়া প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৩১

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, খালেদা জিয়া তখন বিরোধীদলীয় নেতা, ওই সময় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিভেদ-বিভ্রান্তির রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর বিশ্বাস উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের রাজনীতিতে। সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালের মার্চে। রাজপথে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পর রাষ্ট্রক্ষমতায়ও আসীন হওয়া খালেদা জিয়াকে বুঝতে সেই সাক্ষাৎকার প্রাসঙ্গিক এখনও। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রয়াণে সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


মতিউর রহমান: আপনারা বলেন না কেন যে, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চাই, শান্তিপূর্ণ জমায়েত চাই। বোমা, ভাঙচুর, সন্ত্রাস-যেগুলো মানুষের ক্ষতি করে সেগুলো আপনারা করবেন না।


খালেদা জিয়া : আমরা সব সময় বলেছি যে, আমাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, ৭ নভেম্বর (১৯৯৯ সালে, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়) আমাদের যে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হয়েছিল, তাতে হামলা চালানো হলো, বোমা-টিয়ারগ্যাস মারা হলো। তারপর সচিবালয়ের সামনে আমরা বলেই দিয়েছিলাম যে, আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেব। শান্তিপূর্ণভাবেই সেখানে সমাবেশ হচ্ছিল। দলের নেত্রী বক্তব্য দেওয়ার সময় দলের কোনো নেতা-কর্মী নিশ্চয়ই চাইবে না যে পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাক, নেত্রীর বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাক বা নেত্রী বক্তব্য দিতে না পারুন। আমি বক্তব্য দেওয়ার সময় ছাদের ওপর থেকে বোমা, গুলি, টিয়ারগ্যাস মারা হলো। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপরও সরকার আক্রমণ শুরু করল।


আমরা যে গণমিছিল করেছিলাম, বলা হচ্ছে, সেই গণমিছিল থেকে জনকণ্ঠ অফিসে হামলা করা হয়েছে। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছি। কখনোই কোনো পত্রিকা অফিসে হামলা করা হবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না এবং আমরা তা করিওনি। বিশাল গণমিছিল দেখে সরকার ভীত হয়ে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে।


গত ১৩ ফেব্রুয়ারি (২০০০ সালের) চার দল ও সাত দলসহ পেশাজীবীদের নিয়ে যে গণমিছিল হলো, সেটিও ছিল বিশাল, তার ওপরও সরকার পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। আমাদের কর্মসূচি যতই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হোক না কেন, তার ওপরই সরকার এখন আঘাত হানছে, হামলা করছে।


মতিউর রহমান: আমি আবার আপনাদের ঐক্যের কথায় ফিরে যাই। এই ঐক্য নিয়ে কিন্তু আপনার দলের নেতৃত্ব এবং কর্মী-সদস্যদের মধ্যেই হতাশা ও প্রশ্ন আছে। স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতা-কর্মীদের এই ঐক্যের ব্যাপারে অসন্তোষ আছে।


খালেদা জিয়া: আপনি যে কথাটা বলছেন সেটা সঠিক নয়। পত্রপত্রিকায় এসব কথা লেখা হচ্ছে। কারণ আমরা যখন যা কিছুই করি না কেন, সবার আগে চিন্তা করি দল নিয়ে। আন্দোলন বলেন, নির্বাচন বলেন, যেকোনো কর্মসূচিতেই আগে দলকে সম্পৃক্ত করতে হয়। আজকে দেশের যে অবস্থা তাতে সকলেই বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করছে। কিন্তু আমরা মনে করি, আন্দোলনকে সত্যিকারভাবে জোরদার করতে হলে এবং যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যেতে হলে ঐক্যটা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। সে জন্য যার যার অবস্থানে থেকে আন্দোলন না করে আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করার জন্য ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। পার্টিতে সকলে আলোচনা করেই আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজেই এ কথাটা সঠিক নয় যে, এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে বা তারা এ ব্যাপারটি পছন্দ করেননি বা ক্ষুব্ধ।


মতিউর রহমান: মানুষ তো এটা দেখে যে, আপনি এরশাদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন। এখন কত মিটিং-মিছিল করছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে আপনি একসময় কত বক্তৃতা দিয়েছেন। আপনি তাকে হত্যাকারী বলেছেন, তাকে পাঁচ বছর জেলে আটকে রেখেছেন। আবার তার সঙ্গেই এখন ঐক্য করলেন?


খালেদা জিয়া: কথা হলো, কখন আমি ঐক্য করেছি। তারা এখন বিরোধী দল। আমরা কথাগুলো আজকে বলছি। সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। সংসদে আমাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজকে বিপন্ন হওয়ার পথে, মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই, দেশে সন্ত্রাস বিরাজ করছে। দেশের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় তারা সকলে আন্দোলন করছে, একটা অবস্থান নিয়েছে। তারাও সংসদে আছে। বিরোধী দলের নেত্রী কথাটা বলা হলে সংসদের বিরোধী দল হিসেবে তারাও নিশ্চয়ই এসে পড়ে। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তো আমার একটা ভূমিকা রয়েছে, একটা দায়িত্ব রয়েছে। সে জন্যই এই আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী ও জোরদার করার জন্য তারা যদি আমাদের সঙ্গে আসতে চায় এবং আমরা যেসব ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করছি তারাও যদি সেসব নিয়ে আন্দোলন করতে চায়, তাহলে তাদের সঙ্গে রাখা আমরা প্রয়োজন মনে করেছি।


মতিউর রহমান: একই কৌশল তো আওয়ামী লীগও নিয়েছিল। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। আপনারাও অনেক সমালোচনা করেছেন। এখন কী বলবেন?


খালেদা জিয়া: আমাদের সময় আর তাদের সময়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের সময় যে ইস্যুগুলো এসেছে সে ইস্যুগুলো তখন ছিল না। আমাদের সময় দেশের উন্নয়ন হচ্ছিল, দেশের অর্থনীতি ভালো ছিল, দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া হচ্ছিল। শিক্ষার ওপর আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলাম। বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। আমাদের সময় স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ করেছিলাম, আইনশৃঙ্খলা ভালো ছিল, নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা হয়েছিল, উত্পাদন বাড়ছিল, বাড়ছিল রাজস্ব আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো ছিল; মোট কথা দেশের সবকিছু সুন্দর ছিল। বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য কোনো ইস্যু না পেয়ে আওয়ামী লীগ তখন শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে মাঠে নামল। সে জন্যই বর্তমান অবস্থা আর তখনকার অবস্থা এক নয়।


মতিউর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো আপনি শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হলেন।


খালেদা জিয়া: মেনেছি, যেহেতু আমরা দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাই, যেহেতু উন্নয়নের যে ধারা আমরা শুরু করেছি, যেভাবে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি, তা আমরা ব্যাহত বা বিনষ্ট হয়ে যেতে দিতে চাইনি। কিন্তু আমরা বলেছি, সেটি হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। তারা বলেছিল হুট করে দিয়ে দিতে। আমরা বলেছি, সেটা তো সংবিধানে নেই, আমরা সেটা করতে পারি না। এ জন্য তাদের বলেছি, সংসদে আসুন, আলোচনা করুন। আলোচনার মাধ্যমে সময়মতো সে জিনিসটা হবে। কিন্তু তারা হঠাত্ সংসদ থেকে চলে গেলেন। একসময় সংসদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলেন, যে জন্য সেটা করা যায়নি। আমরা আমাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই সেটা করেছি, এবং আমরা সংবিধানকে সংশোধন করেই সেটা করেছি।

মতিউর রহমান: জামায়াতের সঙ্গেও আপনাদের আগে সমঝোতা ছিল, মাঝে ছিল না। আবার তাদের সঙ্গে ঐক্য করলেন। আপনিই কিন্তু তাদের স্বাধীনতাবিরোধী বলে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন।


খালেদা জিয়া: জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন করে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই জাতীয় সংসদে আসে। তখন তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা এবং একটা যোগাযোগ ছিল। আওয়ামী লীগ তখন ছিল বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল এবং সে সম্পর্ক আমরা চেয়েছি। আমরা একত্রে সংবিধান সংশোধন করেছি। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা এত দিন আন্দোলন করেছি, সংগ্রাম করেছি, তা আরো শক্তিশালী করার জন্য আমরা সকলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি।


মতিউর রহমান: আওয়ামী লীগও বলত, যারা সংসদের ভেতরে, তাদের নিয়ে ঐক্য করেছিল। তারপরও আপনারা অনেক সমালোচনা করেছিলেন।


খালেদা জিয়া: আওয়ামী লীগ সংসদে তাদের নিয়ে যে ঐক্য করেছিল, তার তো কোনো ইস্যু ছিল না। তাদের ইস্যু ছিল বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে এবং ক্ষমতায় যেতে হবে। সে জন্যই তারা জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্য করেছিল।


মতিউর রহমান: দেশে বিএনপির একটা শক্তিশালী অবস্থান আছে। এই ঐক্য না করে আপনারা একক থাকলে এবং একটা মধ্যপন্থি দল হিসেবে দাঁড়ালে তো আপনারা আরো এগোতে পারতেন-এটা কি আপনার মনে হয় কখনো? আপনি যেটা আশির দশকে করতেন, একদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একমঞ্চে যাননি, আবার অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও ঐক্য করেননি, এক প্লাটফর্মে যাননি, এককভাবে আন্দোলন করেছেন বা চলেছেন। বিএনপি একটা মধ্যপন্থি দল হিসেবে থাকতে পারলে কি সেটা দলের ভালো হতো না?


খালেদা জিয়া: বিএনপি কিন্তু নিজের অবস্থানেই আছে। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সরিনি। আমি আগেই বলেছি যে, আমরা এককভাবেই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। আমরা আন্দোলন শুরু করার পর তারাও তাদের অবস্থান থেকে আন্দোলন শুরু করল। আমরা দেখলাম, আমাদের ইস্যুগুলো নিয়েই তারা সকলে আন্দোলন করছে এবং জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধি রয়েছে। তারা বলছে, আমরা বিরোধী দল এবং বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে আপনার সঙ্গে এক হয়ে আন্দোলন করতে চাই। আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন হচ্ছে, বিভিন্ন দল আন্দোলন করছে, দেশের মানুষও সেটি চায়, আন্দোলনই যখন হচ্ছে তখন সে আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ হলে সফলতা আরো তাড়াতাড়ি আসবে এবং আন্দোলনের গতি আরো বাড়বে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও