এটি ‘গণভোট’ নয়
বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রথম আলো পত্রিকায় গণভোট নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পড়ে মনে হলো এ বিষয়ে আরও গবেষণাধর্মী লেখার প্রয়োজন রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিডি পার্লামেন্টারি স্টাডিজের পক্ষ থেকে গণভোট–সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বেশ কিছু বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আজকের লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। এ লেখাটি তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নিম্নলিখিত দলিলগুলো বিবেচনা করা হয়েছে— (ক) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫, (খ) জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং (গ) জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি রয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য গণভোটের বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ। এ তিনটি দলিলের মধ্যে প্রথমটি—জুলাই জাতীয় সনদটি একটি রাজনৈতিক দলিল। এ সনদে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ৩৩টি দল/জোটের মধ্যে ২৪টি দল/জোট স্বাক্ষর করেছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ এবং চারটি বামঘেঁষা দল এ সনদে এখনো স্বাক্ষর করেনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি হলো দুটি অধ্যাদেশ, যা রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার জারি করেছে। অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করার কারণে এ দুটি দলিল আগামী জাতীয় সংসদে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে—যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠনের পর প্রথম অধিবেশনে উত্থাপন করে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ তিনটি দলিলে মূলত জুলাই সনদের আলোকে আগামী দিনের জন্য আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে করণীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের আকাঙ্ক্ষা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নীতি ও প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এ তিন দলিলের আলোকে গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু বিষয়ের ওপর জনরায় গ্রহণ করে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর একটা জনভিত্তি গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গণভোট: গত ১৩ নভেম্বর ২০২৫–এ জারিকৃত জুলাই সনদ সম্পর্কিত অধ্যাদেশের ৩ নং, ৪ নং, ৫ নং ও ৬ নং অনুচ্ছেদে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় আইনি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৫ নং অনুচ্ছেদে গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নটি উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় এ প্রশ্নটিকে ঘিরে। গণভোট নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক আলোচনায় বলা হচ্ছে—গণভোটে চারটি প্রশ্নের ওপর সম্মিলিতভাবে একটি (‘হ্যাঁ’/‘না’) ভোট দিয়ে জনগণ তাঁদের মতামত জানাতে বাধ্য হবেন। এ রকম প্রশ্নের কারণে জনগণ চারটি প্রশ্নের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের মতপ্রকাশের সুযোগ পাবেন না। বরং একটি মাত্র উত্তর অপশন থাকার কারণে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণের প্রকৃত মূল্যায়ন জানা সম্ভব হবে না। কোনো কোনো প্রবন্ধে একটি প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠান করার সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করা হলেও বৃহত্তর স্বার্থে এভাবেই গণরায় মেনে নেওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।
গণভোটে আসলে কয়টি প্রশ্ন? গণভোটের প্রশ্নটি আলাদাভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সিপিডির গবেষণায় প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করে গণভোট–সংক্রান্ত বিষয়গুলোর গভীরতা, জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত ফুটে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে একটি হ্যাঁ বা না উত্তরের মাধ্যমে এর সরলীকৃত সমাধান খোঁজার সুযোগ নেই বলে প্রতীয়মান হয়। গণভোটের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে এ প্রশ্নে অনেকগুলো অংশ রয়েছে, যা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে।
গণভোটের প্রশ্নে তিনটি বৃহদাকার ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে জনসম্মতি চাওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো—(ক) জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান) সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর জন্য সম্মতি; (খ) জুলাই সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে সম্মতি; এবং (গ) জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অপরাপর সংস্কার সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সম্মতি। এ তিনটি অংশের মধ্যে জুলাই সনদ সম্পর্কিত বিষয় সংযুক্ত রয়েছে ৮৪টি। এর সঙ্গে গণভোটের অধ্যাদেশের ২৩টি অনুচ্ছেদ এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশের ১৫টি অনুচ্ছেদ যোগ করলে সর্বমোট ১২২টি বিষয়/অনুচ্ছেদ বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হচ্ছে আলোচ্য গণভোটে। এর অর্থ দাঁড়ায় জনগণকে চারটি বিষয়ে নয়, সর্বমোট ১২২টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে—যা হাস্যকর।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি দলিল ধরে বিস্তারিত আলোচনা করলে বিভিন্ন দুর্বলতা ফুটে উঠবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশে সর্বমোট ১৫টি বিষয়ে অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—(ক) জুলাই সনদে বর্ণিত সংবিধান সংস্কার গণভোট; (খ) গণভোটে উপস্থাপনীয় প্রশ্ন; (গ) গণভোট অনুষ্ঠান; (ঘ) গণভোটের জন্য আইন প্রণয়ন; (ঙ) সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কার্যাবলি ও বিলুপ্তি; (চ) শপথ ও শপথ পাঠ পরিচালনা; (ছ) পরিষদের সভা প্রধান; (জ) পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, কোরাম, ভোট দান; (ঝ) পরিষদ ও উহার সদস্যদের দায়ভুক্তি; (ঞ) জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ; (ট) পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার অবিলম্বে কার্যকর করা; (ঠ) পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার চূড়ান্তকরণ ও প্রকাশ এবং (ড) সরকার কর্তৃক নির্দেশনা জারি। বলা হয়েছে, এ অধ্যাদেশের কিছু কিছু অনুচ্ছেদ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এগুলো হলো— ওপরে বর্ণিত (ক), (খ), (গ), (ঘ), (ঞ) এবং (ড) অনুচ্ছেদ। বাকি অনুচ্ছেদগুলো গণভোটের ইতিবাচক ফলাফল সাপেক্ষে সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখে কার্যকর হবে। এ অনুচ্ছেদগুলো হলো— (ঙ), (চ), (ছ), (জ), (ঝ), (ট) এবং (ঠ)। এ অনুচ্ছেদগুলো মূলত সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন সম্পর্কিত। এ অধ্যাদেশ থেকে বোঝা যায়, গণভোটে চারটি প্রশ্নের বাইরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণকে ভোট দিতে হচ্ছে, যা তাঁদের কাছে এখনো অজানা। যার মধ্যে রয়েছে—জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে আগামী সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পরিষদ সদস্যদের দায়মুক্তি ইত্যাদি। এ ছাড়া জনগণ অধ্যাদেশ মোতাবেক কিছু বিষয়ে তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন এবং কিছু বিষয় গণভোটের ফলাফল সাপেক্ষে বাস্তবায়ন বিষয়ে মতামত দেবেন।