জুলাইয়ের স্পিরিট কী, লেখা ছিল গ্রাফিতিতে
অনেক দঙ্গলবাজি চলেছে জুলাইয়ের স্পিরিটের নামে। কিন্তু সেসবের সঙ্গে জুলাইয়ের সংশ্রব সামান্যই। জুলাই স্পিরিট কী, তা লেখা ছিল গ্রাফিতিতে। জুলাই আন্দোলনকালে সাধারণ শিক্ষার্থী-জনতা তাদের ভাবনাগুলো জানাতে থাকে, বিক্ষোভের মাধ্যমে, মিছিলের স্লোগানে, ডিজিটাল মাধ্যমের পোস্টে। তবে সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে তারা জানান দিয়েছে গ্রাফিতির মাধ্যমে—নগরের দেয়ালে লিখে ও ছবি এঁকে।
গ্রাফিতি নিয়ে পরে বইপুস্তকও বেরিয়েছে, কিছু ডিজিটাল আর্কাইভও আছে। সেসব বই বা আর্কাইভের পাতা ওলটালে বোঝা যায়, জুলাইয়ের স্পিরিট আসলে কী ছিল। আজ দেড় বছর পরে জুলাই নামে যা যা করা হচ্ছে বা করতে চাওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে জুলাই স্পিরিটের অনেক ফারাক।
এই নিবন্ধে ‘কেস’ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ওয়েবসাইটের গ্রাফিতি আর্কাইভ নির্বাচন করা হয়েছে। সেখান থেকে চিত্র বা ফিগার বাদ দিয়ে কেবল স্লোগানগুলো স্টাডি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, গ্রাফিতিগুলোর অল্প কিছুই কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বা শিল্পীদের দক্ষ হাতে আঁকা। বেশির ভাগ ছবি আর লিখন অপটু হাতে আঁকা হয়েছে। এর অর্থ হলো, সেগুলো সাধারণ আন্দোলনকারী তরুণ বা জনতার আঁকা। এই লেখার প্রতিপাদ্য এটা দেখানো যে জুলাই আন্দোলনে সাধারণ জনগণ কী চেয়েছিল, তা তারা গ্রাফিতির মাধ্যমে লিখে-এঁকে জানিয়েছিল। সেটাই হলো প্রকৃত জুলাই স্পিরিট।
শিল্পকলা একাডেমির আর্কাইভের ১১১টি গ্রাফিতি বিশ্লেষণ করে মোটাদাগে কতগুলো ক্যাটাগরি পেয়েছি (পরে দেখা গেছে, শিল্পকলা একাডেমির আরও একটি আর্কাইভ রয়েছে, যাতে ১৪৬টি গ্রাফিতি রয়েছে)। গ্রাফিতির ১১১টি আলোকচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই–পরবর্তী দেড় বছরে যা যা ভাবনা হিসেবে জনপরিসরে প্রবল হয়ে উঠেছে, জুলাইকালীন ভাবনা থেকে তা অনেকখানি আলাদা।
গুছিয়ে আলাপ করার জন্য ১১১টি গ্রাফিতিকে কয়েকটি ক্যাটাগরির মধ্যে ফেলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে একেকটি ক্যাটাগরির অধীন আমি যে উদাহরণগুলো সামনে আনছি, তা প্রতিনিধিত্বমূলক। যেগুলো উল্লেখ করা হয়নি, তা হয় একই কথা বলছে, অথবা সেগুলোর তুলনায় এখানে অন্তর্ভুক্ত দেয়ালচিত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা আকর্ষক। নিচের বিশ্লেষণটা করা হয়েছে ক্যাটাগরি ধরে।
আন্দোলনের দাবি/স্লোগান
কোনো আন্দোলনই স্লোগান ছাড়া জমে ওঠে না। দাবিগুলো স্লোগান আকারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্লোগানগুলো সাধারণত সৃজনশীল হয়। গ্রাফিতির আর্কাইভে অনেক স্লোগানের মধ্যে নিচের কয়েকটি প্রতিনিধিত্বমূলক।
ক. ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ স্লোগানটি সম্ভবত জুলাই জাগরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রিয়েটিভ স্লোগান। স্লোগানটি শহীদ আবু সাঈদের ছবিসহ বা তাঁর ছবি ছাড়াই ঘুরেফিরে এসেছে।
খ. ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’—এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান। যে দেশটা মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের ত্যাগে গঠিত হয়েছে, সেখানে একটি দল বা এক ব্যক্তির (এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পিতা) একার নয়।
গ. ‘আওয়াজ উডা’—জুলাই আন্দোলনের সময় লেখা র্যাপার হান্নানের এ গান স্লোগান আকারে গ্রাফিতিতে দেখা গেছে।
ঘ. ‘যদি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ; যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ’ স্লোগানটি ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময়কার। তবে জুলাই আন্দোলনেও ব্যবহৃত হয়েছে, গ্রাফিতিতে তার স্বাক্ষর রয়ে গেছে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের যে একটি প্রবর্ধন জুলাই আন্দোলন, এ হলো তারই প্রমাণ।
ঙ. ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ স্লোগানটি ঢাকার চায়ের দোকানে লিখিত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’কে বদলে দিয়ে প্রণীত। গ্রাফিতির কোনোটায় চায়ের কেটলিসহ পরিবেশিত, সে ক্ষেত্রে ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটি কেটে ‘জরুরি’ লেখা হয়েছে। এ এমন এক সময়, যখন রাজনৈতিক আলাপে প্রবৃত্ত হওয়াই বেশি জরুরি।
চ. ‘বিজয় আসবেই’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে আন্দোলন চলাকালীন সংকল্প দৃপ্তভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গ্রাফিতি
- জুলাই গণঅভ্যুত্থান